পরিবেশদূষণে টানা অবনতি

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

* পরিবেশ ও বন রক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৭৯তম
* বৈশ্বিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশ ৪০ ধাপ পিছিয়েছে
* ২৮ শতাংশই মারা গেছে পরিবেশদূষণজনিত নানা অসুখ-বিসুখে

পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের মানচিত্রে ধারাবাহিকভাবে অবনতি হয়েছে। বনভূমি কমে আসা, বায়ু ও পানিদূষণ এবং পলিথিন-প্লাস্টিকবর্জ্যের বিপদে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের তালিকা থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। গত আট বছরে বৈশ্বিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশ ৪০ ধাপ পিছিয়েছে।

যদিও সংবিধান থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সুরক্ষা সব সময়ই গুরুত্ব পেয়েছে। মূলত পরিবেশ ও বন রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকার কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ২৮ শতাংশই মারা গেছে পরিবেশদূষণজনিত নানা অসুখ-বিসুখে, যা এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।

পরিবেশ সুরক্ষায় বড় বাধা হিসেবে রাজনৈতিক চাপ, প্রভাবশালীদের আইন না মানা, দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এসব বাধা পেরিয়ে এই সরকারের জন্য পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।

সামগ্রিকভাবে দেশের পরিবেশদূষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মহসীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজটি আমাদের মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আলাদাভাবে পরিবেশের একেকটি উপাদানের দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজ করলে তার ফল ভালো আসেনি। তাই বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিআই) গত বছর বিশ্বের ১৮০টি দেশের সরকারের পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ ধাপ পিছিয়ে ১৭৯তম অবস্থানে পৌঁছেছে।

বায়ুদূষণের বড় উৎস ইটভাটার বেশির ভাগই অবৈধ

গত দুই বছরে বায়ুদূষণে ঢাকা শহর বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ শহরের তালিকায় ছিল। কখনো কখনো শীর্ষস্থানেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের এই রাজধানীর নাম। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, রাজধানীসহ দেশের সামগ্রিক বায়ুদূষণের ৫৬ শতাংশের উৎস ইটভাটা। ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে সরকার ২০১৮ সালে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করেছে। নতুন ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সব কটি ইটভাটাকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করার কথা। কিন্তু ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানিয়েছেন, দেশের ৭ হাজার ৭৭২টি ইটভাটার মধ্যে ২ হাজার ২২৩টি উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ইটভাটাগুলো কৃষিজমিতে স্থাপন করা যাবে না, কৃষিজমি থেকে মাটি তুলে ইট বানানো যাবে না। এ ছাড়া জনবসতি, বাজার ও অর্থনৈতিক তৎপরতা আছে এমন এলাকায় ইট ভাটা রাখা যাবে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, ৯৮ শতাংশ ইটভাটা নতুন আইন অনুযায়ী অবৈধ। সম্প্রতি অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু স্থানীয় উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের কার্যালয় স্থানীয় পর্যায় থেকে এলআর ফান্ড নামে একটি বিশেষ তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। তাদের অনানুষ্ঠানিক খরচ মেটাতে সংগ্রহ করা ওই তহবিলের বড় অংশ আসে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে। ২০১৮ সালের জুনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ওই তহবিলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবি জানিয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় সাংসদও এই তহবিলের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান পালনের অর্থ আসে ওই তহবিল থেকে। ফলে তা বন্ধ হচ্ছে না। আর অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধেও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

পরিবহন থেকে দূষণ

রাজধানীর পরিবেশদূষণে পরিবহন খাতের মধ্যে অন্যতম উৎস ছিল থ্রি–স্ট্রোক ইঞ্জিনের বেবিট্যাক্সি। সরকার আইন করে ২০০১ সালে এসব গাড়ি উচ্ছেদ করে। এর বদলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু হয়। জ্বালানি হিসেবে বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহনেও সিএনজি সিলিন্ডার ব্যবহার জনপ্রিয় করা হয়। এতে রাজধানীর বায়ুর মানের অনেক উন্নতি হয়, অর্থাৎ দূষণ কমে আসে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণে পরিবহন খাতের ভূমিকা ১৬ শতাংশ।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন, বিশেষত বাসগুলো সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দূষণকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু পরিবহন খাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রভাব থাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে এই দুটি সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

নদী ও বনের ধারে বড় শিল্প, দূষণও বেশি

পরিবেশবিষয়ক সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় পরিবেশ কমিটি। ২০০৯ সালে ১২ বছর পর জাতীয় পরিবেশ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ঢাকার নদীদূষণ বন্ধ করার মতো উদ্যোগের পাশাপাশি গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে গড়ে ওঠা আড়াই শ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন শর্তে বৈধতা দেওয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে ওই কমিটির সভা হয়। সেখানে সুন্দরবনের পাশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩২০টি শিল্পকারখানাকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।

বায়ুদূষণের পাশাপাশি নদীর পানির দূষণ মাপে পরিবেশ অধিদপ্তর। সেখানেও ভীতিকর চিত্র। রাজধানীর চারপাশের চারটি নদীর পানি পান ও প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বহু বছর আগে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মেঘনা, ধলেশ্বরী ও কর্ণফুলী। এসব নদীর তীরে গড়ে ওঠা দূষণকারী শিল্পকারখানার বেশির ভাগের মালিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা। এমনকি বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সাংসদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নদীদূষণের অভিযোগ ওঠে। পরিবেশ অধিদপ্তর সেগুলোকে জরিমানাও করেছে। সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নদী দখল ও দূষণের অভিযোগ তুলেছে। উচ্চ আদালত থেকে এ মাসে দেশের নদী রক্ষায় একটি যুগান্তকারী রায় দেওয়া হয়েছে। রায় অনুযায়ী, নদী দখলকারীরা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হবেন।

এত দিন নদীগুলোর দখল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো কী করেছে, সেই প্রশ্ন তুলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, দখল ও দূষণকারীদের তালিকা করা হচ্ছে। তাঁরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ছাড়পত্র দিয়েই দায়িত্ব শেষ পরিবেশ অধিদপ্তরের

পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্যতম কাজ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকারখানাকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া ও তা নবায়ন করা। কিন্তু এসব কারখানা পরিবেশ রক্ষার শর্ত ঠিকমতো মানছে কি না, তা তদারকি নিয়ে দুর্বলতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগও পুরোনো।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে বর্জ্য পরিশোধনযন্ত্র স্থাপন করা উচিত এমন কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৬৫। এর মধ্যে ৫০০টি কারখানায় ওই দূষণনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। এর বাইরে মারাত্মক দূষণকারী ৩০৮টি কারখানা পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কারখানার মধ্যে মাত্র ১২টি নিয়ম মানছে। আর যাদের ইটিপি আছে, তাদের বেশির ভাগই চালু রাখে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এখনো পলিথিন

দেশের মাটি ও পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ বর্তমানে এমন কোনো বাজার পাওয়া যাবে না, যেখানে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে না। রাজধানীর লালবাগ, চকবাজার, টঙ্গী, গাজীপুর বা চট্টগ্রামে এখনো অবৈধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের কারখানা ও পাইকারি দোকান পাওয়া যাবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে এমন কারখানার সংখ্যা প্রায় ১৫০।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৮ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্লাস্টিক–দূষণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডিও) ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাটি ও পানিতে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। দেশে বছরে যেখানে জৈববর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক–বর্জ্যের বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ।

বনভূমি কমছে, বন বিভাগ কী করছে

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি কাজ দেশের বনভূমি রক্ষা করা। সেই কাজ করার দায়িত্ব বন অধিদপ্তরের। বন অধিদপ্তরের নথিতে দেশের বনভূমির পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখ করা হলেও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। বন অধিদপ্তর বলছে, দেশের মোট ভূমির ১৭ শতাংশ বনভূমি। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বনভূমিবিষয়ক তাদের বার্ষিক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১৩ শতাংশ।

দেশের বনভূমির চিত্র নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই)। গত বছরের ২৭ জুন তাদের এক প্রতিবেদন বলছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে।

এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বনভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর নানা উন্নয়নকাজে ভূমির প্রয়োজন হলে প্রথমেই বনের জমির দিকে নজর দিচ্ছে। দেশের বনভূমি রক্ষা করতে হলে বন বিভাগকে আরও সাহস দেখাতে হবে বলে মত দেন তিনি।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গত বছরের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের বনভূমি অন্য খাতে চলে যাওয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। তাতে বলা হয়, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার একর বনভূমি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুধু গত বছরে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও বেসরকারি খাত ১৬ হাজার একর বনভূমি নতুন করে বরাদ্দ চেয়েছে।

দেশের পরিবেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যখন বলা হয়, ‘বাঘের জন্য-সুন্দরবনের জন্য মায়া বেশি, আর মানুষের জন্য মায়া নেই’, ‘আগে উন্নয়ন, তারপর পরিবেশ রক্ষা’। এসব কথা শুনে বোঝা যায় সরকার পরিবেশ ও বন রক্ষার অঙ্গীকার থেকে ক্রমাগত সরে আসছে। আর পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পঙ্গু প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে এই দুটি সংস্থার পুনর্গঠন ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না।

আইনুন নিশাত
আইনুন নিশাত

বিশেষজ্ঞ অভিমত

পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে আরও সাহসী হতে হবে
আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষা সমন্বয় করা। আমাদের পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট আইন রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কাজ আইনগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা। তবে পরিবেশ রক্ষার কাজটি শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার নয়। সরকারের অন্য সংস্থাগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি পরিবেশ অধিদপ্তর অনেক বেশি প্রকল্পনির্ভর। তারা এত দিন উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়ননির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ফলে পরিবেশ রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাদের যে তদারকির ভূমিকা নেওয়ার কথা, সেখানে ঘাটতি রয়েছে। এর ফলাফল আমরা দেখি, দূষণের বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

যেমন রাজধানীর বায়ুদূষণ, নদী রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পভিত্তিক অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের কোনো সুফল আমরা দেখিনি। আর প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সুরক্ষার ওই কাজগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব কাজ টেকসই হয়নি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পারে, নিজেদের কারিগরিভাবে সক্ষম জনবল তৈরি করতে পারে, দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো জনবলকাঠামো গড়ে তুলতে পারে, তাহলে দূষণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া সম্ভব।

অন্যদিকে দেশের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু, অর্থাৎ দূষণকারীরা বেশ ক্ষমতাবান। দূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার মতো ক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। এর বাইরে গিয়েও অনেক সময় আমরা দেখেছি পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে চলে যাওয়ার পর সেই কার্যক্রম থমকে গেছে। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর করতে হলে তাদের শক্তিশালী করতে হবে। আর সর্বোপরি তাদের সাহসী হতে হবে।

বন রক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনা দেখতে পাই। বন অধিদপ্তরের কাজ দেশের বনভূমি রক্ষা করা। কিন্তু তারা অনেক বেশি রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী। এটা তাদের কাজ না। বরং রাজস্ব আদায়নির্ভর মানসিকতা বন রক্ষার ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর বন অধিদপ্তর সব সময় বন রক্ষাকে নিজেদের একক দায়িত্ব হিসেবে দেখেছে। এটা ঠিক নয়। স্থানীয় জনগণকে কার্যকরভাবে যুক্ত করতে না পারলে বন রক্ষা হবে না। এ ছাড়া বনের জমি অন্য খাতে চলে যাওয়া নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বন অধিদপ্তরের আপত্তি এ ক্ষেত্রে ধোপে টিকছে না। এ ছাড়া জোর করে ও অবৈধভাবে বন দখলের বিষয় তো রয়েছেই।

ফলে পরিবেশ ও বন রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করতে হবে। তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো অন্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নৈতিক অধিকার তাদের থাকবে না। ২০১১ সালে দেশের সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় বনভূমি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সবুজ অর্থনীতির দিকে যাত্রার কথাও বলা হয়েছে। আশা করব, সরকারি সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের ওই দায়িত্ব ও অঙ্গীকার সঠিকভাবে পালন করবে।