রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানো যাবে কবে?

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
>

• পররাষ্ট্রনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান
• দীর্ঘ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট
• ভারত আর চীনের মধ্যে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখাও জরুরি

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবতার নতুন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে বাংলাদেশ। শক্তিধর দু-একটি দেশ ছাড়া পুরো পৃথিবীই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমার সেনাদের বিচারের দাবিও জোরালো হয়েছে। কিন্তু চুক্তি সই করেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি মিয়ানমার। তাই শিগগিরই যে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানো শুরু করা যাচ্ছে না, সেটা একরকম নিশ্চিতই বলা চলে। এমন এক পরিস্থিতিতে সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান।

রোহিঙ্গা সমস্যার পাশাপাশি কাছের পড়শি ভারত আর অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে একধরনের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করে চলা সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া এবার সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন দেশ অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের প্রসঙ্গটি সামনে এনেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার স্বার্থেই গণতান্ত্রিক উন্নয়নে জোর দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার, সুশাসন আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার কথা বলছে। তাই এ ক্ষেত্রে সরকার দৃশ্যমান কতটা উন্নতি করছে, সেদিকে নজর থাকবে বন্ধুদেশ, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর।

আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে অনিবার্যভাবে ব্যবসা বিনিয়োগের প্রসঙ্গগুলো জড়িত। সাবেক কূটনীতিকেরা মনে করেন, এটি সময়োপযোগী অগ্রাধিকার। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে অভ্যন্তরীণ নীতিকাঠামোতে সমন্বয় করতে হবে। এ জন্য কূটনীতিতে পেশাদারির ওপর জোর দিতে হবে। অগ্রাধিকার ঠিক করে এগোতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সাফল্য পেতে হলে মৌলিক অনেক বিষয়ে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এখন অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কতটা তৈরি, সেটাও দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ঢাকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্মরত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপির আওতায় তৈরি পোশাকের বাজার অব্যাহত রাখা সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হতে পারে। রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কাঠামোগত উন্নতি ঘটিয়ে কর্মপরিবেশে গুণগত পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ, যা প্রশংসা কুড়িয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের। কর্মপরিবেশের উন্নতি হলেও শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার কিছু কিছু বিষয় নিয়ে অসন্তোষ আছে পশ্চিমা ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর। এসব অসন্তোষ দূর করে তৈরি পোশাকের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।


দীর্ঘ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট
নিরাপত্তাচৌকিতে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহ নৃশংসতা শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্বিচারে খুন, গণধর্ষণ ও হেলিকপ্টার থেকে দাহ্য পদার্থ দিয়ে রাখাইনের জনপদ নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে নামে মিয়ানমার। জাতিসংঘের ভাষায় ‘গণহত্যা’ আর ‘জাতিগত নিধন’ থেকে প্রাণ বাঁচাতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সারা বিশ্বের সমালোচনার মুখে পড়ে ওই বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তিও সই করে মিয়ানমার। শেষ পর্যন্ত এক বছর পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমার রাখাইনে এমন কোনো পরিবেশ তৈরি করেনি, যা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরতে উৎসাহ দেয়। উল্টো কিছুদিন পরপরই মিয়ানমার বলার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়াকে কেন্দ্র করে উদ্বেগের কথা জানান। আব্দুল মোমেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিতে পারে। এটি ঘটলে তা শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই রোহিঙ্গারা যত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে, ততই মঙ্গল।’

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও মিয়ানমার থেকে দেশটির নাগরিকদের আসা থেমে নেই। গত জানুয়ারি থেকে রাখাইন আর তার পাশের রাজ্য শানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে নতুন করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন মিয়ানমারের সেনারা। এর জের ধরে মিয়ানমারের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরাও বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। এদিকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে কারাবন্দী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশটি।

সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক এবং জাতিসংঘে কাজের অভিজ্ঞতাপুষ্টরা বলছেন, সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের পাশাপাশি ভারত ও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশকে দর-কষাকষি করার সময় এসেছে। কারণ, এমনিতেই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল কক্সবাজারের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করেছে। তৈরি করছে আর্থসামাজিক নানা সমস্যা। এরপর ভারত আর সৌদি আরব থেকে বাড়তি রোহিঙ্গার উপস্থিতি সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে।

কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন বলছেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নতুন করে সাগরপথে মানব পাচারের বিষয়টি নজরে এসেছে। সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারীরা অতীতের অপরাধী নাকি নতুন চক্র গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে কৌতূহল আছে। সাগরপথে মানব পাচারের পাশাপাশি শিবির থেকে কক্সবাজারে শিশু পাচারও নতুন সমস্যা বলছে রোহিঙ্গারা।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটা এখন যেখানে এসে আটকে গেছে, তাতে শুধু দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় উদ্যোগের একটি ধরে এগোলে চলবে না। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভারত, চীন ও জাপানের মতো দেশগুলোকে নিয়েও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

ভারত আর চীনে ভারসাম্য
এক দশক আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ইতিহাসের নতুন বাঁকে মোড় নেয়। বিশেষ করে নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ দূর করাকে ২০০৯ সাল থেকেই বাংলাদেশ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশের এই ভূমিকার প্রশংসা কংগ্রেস সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যেমন করেছেন, তেমনি বিজেপির আমলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রতিরক্ষা, মহাকাশের মতো সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ভারত। তাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আর সীমান্তের দুই পাশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে পাশে ছিল ভারত। ওই সময় ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের নির্বাচন এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনীতিবিদেরা। এরপর কয়েক মাস ধরে পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচন নিয়ে সমালোচনায় মুখর হলেও সময় গড়ানোর সময় তারাও সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প খুঁজে পায়নি। বলে রাখা ভালো, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর চীনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল রাশিয়া।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিসরে বড়ভাবে জড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের পর দেশটি বাংলাদেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এত বিপুল অর্থ ব্যবহারে বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেই সঙ্গে চীনের বিপুল অর্থ ব্যবহারের পর ঋণের ফাঁদে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আটকে পড়ার বিষয়টি সামনে আনছেন বিশ্লেষকেরা।

এ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর গত বছরের ২৫ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামবানতোতায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে চীনের জন্য ১০০ কোটি ডলার ছাড় দিলেও শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। কারণ, একতরফা ওই অর্থায়নের প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর সুদের হার বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক যেকোনো ঋণদানকারী সংস্থার চেয়ে কয়েক গুণ চড়া। ওই প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়েছে, ওই বছর দেশটির রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বের নানা প্রান্তে ওই বছর শ্রীলঙ্কার ঋণ শোধের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৩০ কোটি ডলার।

এ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিরাপত্তা, ট্রানজিটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা দিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ তিস্তাসহ দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সুরাহা হয়নি। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা কখনো কখনো ভারতের মধ্যে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেটা সরকারকেই ঠিক করতে হবে।

সুশাসনে দৃষ্টি পশ্চিমাদের
টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ইলি মাউয়েরসহ বিশ্বনেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে ভবিষ্যতে যুক্ত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এর পাশাপাশি তাঁদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়েও জোর দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমি আশা করব, ন্যায্য বাণিজ্য আর বিনিয়োগ এবং মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আপনি গুরুত্ব দেবেন।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে নির্বাচনী অনিয়মের তদন্তে আন্তর্জাতিক অনুরোধের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, সুশাসন হচ্ছে উন্নয়নের সফটওয়্যার। মানুষ যদি স্বস্তিতে না থাকে, অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়, দুর্নীতির শিকার হয়, তবে তো পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে অনাস্থা তৈরি হবে। কাজেই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।

মো. তৌহিদ হোসেন
মো. তৌহিদ হোসেন


বিশেষজ্ঞ অভিমত
বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, সুশাসন
মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
দেড় বছরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো মিয়ানমার এখন পারলে রাখাইনের সব রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তিটি যে শুরু থেকেই ভালো ছিল না, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক শক্ত কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবাসন চুক্তিতে এসবের প্রায় কিছুই নেই। মিয়ানমার যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের নেওয়ার কথা বলছে, তাতে প্রত্যাবাসন শেষ করতে অনন্তকাল লাগবে। চূড়ান্ত কথাটি হচ্ছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। কারণ চীনের পাশাপাশি ভারতও তাদের সঙ্গে আছে। দুই দেশের কাছেই মিয়ানমারের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেশি। চীনকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর সুযোগ করে দিয়েছে মিয়ানমার। আর চীনের ওপর নির্ভরশীলতা আছে মিয়ানমারের। এটা অনস্বীকার্য যে রোহিঙ্গা সংকটে চীন ‘অনেস্ট ব্রোকারের’ ভূমিকা পালন করলে পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো হতে পারত।

সৌদি আরব থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এটি বিবেচনায় নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ‘নীরব কূটনীতি’ চালাতে হবে। কারণ ইয়েমেনের সঙ্গে ‘অন্যায় যুদ্ধে’ আমরা সৌদি আরবকে পরোক্ষ সমর্থন করেছি। আজকের দিনে নীতি নয়, স্বার্থই সবচেয়ে বড় প্রভাবক। তাই সৌদি আরবের অন্যায় যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার সময় বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে। দর-কষাকষি করতে হবে। অর্থনীতি আর উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ এক নয়। আমাদের গুরুত্ব বেড়েছে। অথচ আমরা এখনো সেই অবস্থানের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। কাজেই যেকোনো দেশ কোনো প্রস্তাব দিলে তা সঙ্গে সঙ্গে মেনে না নিয়ে নিজেদের স্বার্থকে সবার আগে বিবেচনা করেই এগোতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটের নিরিখে এটা বলা যায়, এ সমস্যার সমাধান খুব সহজে হবে না। কারণ, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিতে রাজি নয়। চীনও হুট করে মিয়ানমারকে চাপ দেবে-এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আবার জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিক নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হলেও ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরানো ঠিক হবে কি হবে না, এটা সামনে আনছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ কী করবে? এ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘ সময় লাগবে, এটা ধরে নিয়ে এগোতে হবে। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, যে দেশগুলোতে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে অপরাধীদের বিচার না করে সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অনেক বিনিয়োগ করেছে। চীনের অর্থ ব্যবহারের প্রক্রিয়া, কাজের মান-এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো নিয়ে কোনো না কোনো পরিসরে আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের সুশাসন পরিস্থিতির উন্নতি হলে চীনের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের সার্বিক মানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যের বিষয়ে আমি খুব চিন্তিত নই। ভারতের আর্থিক সামর্থ্য কম, কিন্তু ভূরাজনৈতিক কারণে ভারত অবশ্যই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। অন্যদিকে চীনের মূল শক্তি তার অর্থনীতি। আমাদের দেখতে হবে, আমরা যেন পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের ফাঁদে না পড়ি।

সুশাসনের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে গত নির্বাচন বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য একটি নেতিবাচক দিক। গণতন্ত্র মানে অবশ্য শুধু নির্বাচন নয়, নির্বাচন যেকোনো দেশের গণতন্ত্র মূল্যায়নের মানদণ্ড। সবশেষ নির্বাচন যে মানসম্পন্ন হয়নি, সেটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচন নিয়ে বন্ধু দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতায় জড়াবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। আদর্শিক জায়গা থেকে বিষয়গুলো নিয়ে তারা কথা তুলবে। আর সুশাসনের প্রসঙ্গটি যখন তারা আলোচনায় আনবে, সে সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন-এসব বিষয় তারা সামনে নিয়ে আসবে। তাই এ বিষয়গুলোতে অনেক উন্নতি করতে হবে। আর এই উন্নতির জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি।