অভিজিৎ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া, সঙ্গে আরও ১০ জন

টানা তিন দিন অনুসরণ করে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক।

ঘটনার প্রায় চার বছর পর অভিজিৎ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেছে পুলিশ। পলাতক জিয়াউল হককে প্রধান আসামি করে ছয়জনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত অভিযোগপত্রটি আজ সোমবার অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ওই অভিযোগপত্র পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

আজ রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মোট ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকিদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্রে তা দেওয়া হবে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যাকারীরা অপেক্ষা করতে থাকেন। একপর্যায়ে নিশ্চিত হয় অভিজিৎ দেশে ফিরেছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা অভিজিৎকে বইমেলায় আসা যাওয়ার পথে রেকি করতে থাকেন। এর মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে তাঁরা অভিজিৎকে দেখেন। তিনি ওই দিন স্ত্রীকে নিয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে খেতে গিয়েছিলেন। সেখান পর্যন্ত তাঁকে অনুসরণ করেন হত্যাকারীরা। কিন্তু সেদিন তাঁরা অপারেশন করতে পারেননি। এরপর তিন দিন টানা তাঁকে অনুসরণ করেন হত্যাকারীরা। রেকি করার দায়িত্ব ছিল মোজাম্মেল ও আবু সিদ্দিকের। হত্যাকাণ্ডের দিন জিয়াউল ও তাঁর আরেক সহকারী সেলিমও ঘটনার আশপাশে ছিলেন।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদও গুরুতর আহত হন।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন হলেন: মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (২৫) (সাংগঠনিক নাম শাহরিয়ার), মো. আবু সিদ্দিক সোহেল (৩৪) (সাংগঠনিক নাম সাকিব, সাজিদ, শাহাব), মো. আরাফাত রহমান (২৪) (সাংগঠনিক নাম সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ) ও শাফিউর রহমান ফারাবী (২৯)। এর মধ্যে মোজাম্মেল, আরাফাত ও আবু সিদ্দিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আবু সিদ্দিক ও মোজাম্মেল জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যারও অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।

পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে মোজাম্মেল, আবু সিদ্দিক ও আরাফাত সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত। অন্য কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, কীভাবে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে, কেন সংঘটিত, সবকিছুর বর্ণনাই তাঁদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আছে। হত্যাকারী বা তাদের নেটওয়ার্কের সঙ্গে শাফিউরের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিজিৎকে নিয়ে তার দেওয়া পোস্ট ও মন্তব্যগুলো অভিজিৎকে টার্গেট করা এবং হত্যাকাণ্ডটি সংঘটনের পেছনে ‘প্রভাবক’ হিসেবে কাজ করেছে বলে তাঁরা মনে করছেন। এ জন্য তাঁকে প্ররোচনাকারী ও উসকানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শাফিউরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‍্যাব। এর মধ্যে বাকি সাতজনকেই এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া (সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত) (৪২) ছাড়াও অন্যজন হলেন পলাতক আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আবদুল্লাহ (৩০)।

সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি-প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনার মোটিভ হিসেবে যা পাওয়া গেছে তা হলো তাঁর লেখালেখি ও ভিন্নমতের কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মূলত ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’—এই দুটি বইকে কেন্দ্র করেই তাঁরা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।

পলাতক জিয়াউলের নেতৃত্বে ১১ জন ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ, আমাদের তদন্তে প্রাপ্ত অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণাদির পাশাপাশি বিশ্বস্ত গুপ্তচরের তথ্য—সবকিছু মিলিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে পলাতক মেজর জিয়া। তার নেতৃত্বে মোট ১১ জন ঘটনাটি সংঘটিত করেছে। কিলিং স্কোয়াডের প্রধান ছিল মুকুল রানা, যে ইতিমধ্যেই ডিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন আগেই অভিজিৎকে টার্গেট করা হয়। আমেরিকা থেকে তিনি কবে দেশে ফিরবেন, সেটি জানার জন্য তারা বিভিন্ন ভাবে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। অভিজিতের বন্ধুবান্ধব, পরিবার সব জায়গায় তারা গোপনে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ভক্ত, প্রকাশনী ও বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে তারা নিশ্চিত হয়, বইমেলার সময় অভিজিৎ দেশে আসতে পারেন। সেই অনুসারে তারা এলিফ্যান্ট রোডে তাদের ‘অপারেশনাল হাউস’ ভাড়া নেন।

মনিরুল ইসলাম বলেন, আনসার আল ইসলামের একটি ডিসিশন মেকিং বডি আছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা অভিজিতের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে মেজর জিয়া ও আরেকজন স্পিরিচুয়াল লিডারকে দিলে তাঁরা সিদ্ধান্ত দেন যে তাঁকে হত্যা করা যাবে। সে ক্ষেত্রে কে কে এটার দায়িত্বে থাকবে, তা-ও তাঁরা নির্ধারণ করে দেন। ইনটেল ও কিলার, এই দুটি গ্রুপে কাজ করে হত্যাকারীরা। এই উভয় গ্রুপের সদস্যরাই গ্রেপ্তার হয়েছেন।

মেজর জিয়ার অবস্থানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জিয়ার অবস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে সে আর সেভাবে সক্রিয় নেই। সক্রিয় হলে বা কোনো অ্যাক্টিভিটিজ চালালে আমরা হয়তো তার লোকেশন টের পাব। এই মুহূর্তে পুরো সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় আছে। ২০১৬ সালে জুলহাস মান্নানকে হত্যা করার পর তারা আর কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটাতে পারেনি। তারা খুব একটা অ্যাকটিভ আছে, সেটা বলা যাবে না।’

এই মামলায় র‍্যাবের গ্রেপ্তার করা আট আসামির বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তার এই আটজনের মধ্যে শুধু ফারাবির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা এই মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য মামলা আছে। সেগুলোর তদন্ত ভিন্নভাবে হচ্ছে।’

২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তিন বছর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে। পরের এক বছর তদন্ত করে সিটিটিসি। মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্তে আনসার আল ইসলাম নামে একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বলে প্রমাণিত হওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।