আশার গুড়ে বালি, ইয়াবা আসছেই

জব্দ ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
জব্দ ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
>

• তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫১
• তালিকার বাইরে আরও হাজারখানেক কারবারি চক্র
• বাইরের কারবারিদের রসদ জোগাচ্ছেন গডফাদাররা
• বাইরে থাকা চক্রের কেউ এখনো আত্মসমর্পণ করেননি
• ফলে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই

ইয়াবা বড়ি কারবারিদের আত্মসমর্পণের পর এলাকার মানুষ ধারণা করেছিলেন, এই অপরাধী চক্রের নেটওয়ার্ক ভেঙে যাবে। বন্ধ হবে ইয়াবা আসাও। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। আত্মসমর্পণের দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিদিনই ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ধরা পড়ছে।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫১। কিন্তু তালিকার বাইরে আরও হাজারখানেক ইয়াবা কারবারি চক্র সক্রিয় আছে। তাদের রসদ জোগাচ্ছেন গডফাদাররা। এই চক্রের কেউ আত্মসমর্পণ করেননি। ফলে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাঁদের ধরতে শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরদার অভিযান ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কারণে ১০২ ইয়াবা কারবারি ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অস্ত্র, ইয়াবাসহ আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁরা এখন কক্সবাজার জেলে আছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৫১ ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বা গডফাদার আছেন ৭৩ জন। গডফাদারদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছেন ৩০ জন। ৪৩ জন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন।

গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে শুধু কক্সবাজারেই ৫৩ জনের মৃত্যু হয়। তারপরও গডফাদার ছাড়া শুধু তালিকাভুক্ত অধরা ব্যবসায়ীই আছেন এক হাজারের মতো। এই তালিকার বাইরে নতুন অনেক ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছেন, যাঁরা গোপনে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

গডফাদাররা এলাকায়
টেকনাফে যেদিন ইয়াবা কারবারিরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, সেদিনই জেলার তিনটি স্থান থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এরপর গতকাল সোমবার ভোররাতে টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকা থেকে বিজিবি ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে। এর আগের দিন শনিবার র‍্যাব উদ্ধার করে ৪০ হাজার ইয়াবা। তার আগের দিন শুক্রবার রামুর পাহাড় থেকে উদ্ধার হয় ৪ লাখ ৪০ হাজার এবং সমুদ্রের নৌকা থেকে পাওয়া যায় ১ লাখ ইয়াবা। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, যেসব গডফাদার বাইরে আছেন, তাঁরাই ইয়াবা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার ১ নম্বরে ছিলেন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি। তাঁর পরিবারের ১২ সদস্য আত্মসমর্পণ করলেও তিনি নিজে অনুষ্ঠানের ধারেকাছে আসেননি। তাঁর এই অনুপস্থিতি নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। লোকজন বলছেন, ইয়াবার অপবাদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অন্যদের আত্মসমর্পণের দিকে ঠেলে দিয়েছেন বদি। অথচ তালিকায় থাকা বদির আপন ভাই মৌলভি মজিবুর রহমান আত্মসমর্পণ করেননি। মজিবুর এলাকায় বদির পরে দ্বিতীয় গডফাদার বলে চিহ্নিত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার ২ নম্বরে থাকা সাইফুল করিম দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে। তালিকার ৬ নম্বরে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ, ৯ ও ১০ নম্বরে আছেন তাঁর দুই ছেলে শাহজাহান মিয়া (টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান) ও ইলিয়াছ মিয়া। ২৬ নম্বরে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভি রফিক উদ্দিন, ২৫ নম্বরে বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভি আজিজ উদ্দিন, ৩৯ নম্বরে আছেন জাফর আলম। নানা কৌশলে তাঁরা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইয়াবা কারবারে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী
টেকনাফের বাসিন্দারা জানান, রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-কর্মী আছেন, যাঁদের নাম তালিকায় আছে। কিন্তু এই অভিযানে তাঁদের গায়ে হাত পড়েনি। আবার তাঁরা আত্মসমর্পণও করেননি। রাজনৈতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে তাঁরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে যেমন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আছে, তেমনি বিএনপি–জামায়াতের নেতা-কর্মীও আছেন।

তালিকাভুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উল্লেখ্যযোগ্য হলেন টেকনাফ পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাবেদ ইকবাল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এজাহার মিয়া, পৌর যুবলীগের সাবেক সভাপতি মনজুরুল করিম সোহাগ, পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হোসেন আহমদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও প্রকাশনা সম্পাদক নজির আহমদ সীমান্ত, টেকনাফ সদর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল কাদের, সাবরাং ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম, উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের খান, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন, সাবেক কাউন্সিলর ফরিদ আহমদসহ আরও অনেকে। তাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি।

একইভাবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাফর আলম, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুল করিম মার্কিন, জেলা বিএনপির সদস্য ও টেকনাফ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহ আলম, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি হাশেম মেম্বার, উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাহেদুল ইসলাম মাহমুদ, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ, পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাচা মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। জামায়াত নেতা ও টেকনাফ পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মো. ইসমাইলের নামও তালিকায় আছে।

 তালিকাভুক্ত এসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ইয়াবা বন্ধ হবে কীভাবে, জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা ও হুন্ডিতে জড়িত থাকা ৩৭০ জনের একটি তালিকা করেছে পুলিশ। তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

তবে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদজামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে ইয়াবা বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য এলাকাবাসীরও সহযোগিতা লাগবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফ শাখার সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, যাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁদের নেটওয়ার্ক ও সিন্ডিকেট সদস্যরা এলাকায় রয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকের নাম তালিকাতেও নেই। এ অবস্থায় ইয়াবা বন্ধ হবে এমন আশা করাটা ভুল।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ঘটা করে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান করা হলেও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের টনক নড়েনি। মানুষ দেখতে চায়, গডফাদারদের কিছু হোক। তাঁদের কিছু না হলে ইয়াবা ব্যবসা চলতেই থাকবে।