নতুন সংগঠন করার কথা বলল জামায়াত

>

• দায়িত্বশীল নেতাদের জরুরি নোটিশ দিয়েছে জামায়াত
• তাতে নেতা–কর্মীদের কারও অনুরোধে সাড়া না দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে
• নতুন সংগঠন গড়তে পাঁচ সদস্যের কমিটি
• এর আগেও এমন কমিটি হয়েছিল, কিন্তু তা এগোয়নি

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং দলের বিলুপ্তিসহ সংস্কার আনতে ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর বেশ চাপে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীদের এই বলে আশ্বস্ত করছে যে একটি নতুন সংগঠন গড়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে।

জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বিলুপ্ত করে নতুন নামে দল গড়ার পরামর্শ আসছিল দলের ভেতর থেকে। কিন্তু দলের পুরোনো ধারার অংশটি তা আমলে নেয়নি। গত শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর আরও অনেকে তাঁকে অনুসরণ করতে পারেন, এই আশঙ্কায় ওই দিন বিকেলেই ‘দৃষ্টি আকর্ষণী’ শিরোনামে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে একটি জরুরি নির্দেশনা পাঠানো হয়। তাতে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নতুন সংগঠন গড়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ এবং সাবেক কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সাবেক সদস্য মুজিবুর রহমানকে (মঞ্জু) দলীয় সদস্য পদ বাতিল করার বিষয়েও ব্যাখ্যা করা হয়।

সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পাঠানো নোটিশে জামায়াত বলেছে, গত ১৪ জানুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অধিবেশন হয়। সেখানে নেওয়া কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। এরপর শুরার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাহী পরিষদ একটি নতুন সংগঠন গড়াসহ কিছু সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। নোটিশে নেতা-কর্মীদের এই বলে সতর্ক করা হয় যে সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত আমির, সেক্রেটারি, অঞ্চল দায়িত্বশীল এবং জেলা ও মহানগর আমিরদের মাধ্যমে যথাসময়ে জানানো হবে। এর বাইরে কারও আবেদন, নিবেদন ও অনুরোধে কোনো জনশক্তি যাতে সাড়া না দেন, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিতে হবে।

জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, এর আগেও দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন নামে দল গড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় নেতা হামিদুর রহমান আজাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়েছিল। এ কমিটি নতুন দল গড়ার বিষয়ে মাঠপর্যায়ের মতামত নিয়েছিল। কিন্তু পরে এ তৎ​পরতা থেমে যায়।

জামায়াতের মাঠপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর চাপের মুখে আবার নতুন সংগঠন করার ঘোষণা দেওয়া হলো। যদিও আবদুর রাজ্জাক যে দুটি কারণ উল্লেখ করে পদত্যাগ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জামায়াতের বিলুপ্তি।

পদত্যাগপত্রের এক জায়গায় আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন, ‘সবশেষে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন।’

এরপর জামায়াতের ‘দৃষ্টি আকর্ষণী’ নোটিশে দলের নেতা-কর্মীদের আবদুর রাজ্জাকের প্রতি কোনো বিরূপ মন্তব্য না করার অনুরোধ জানানো হয়। নোটিশে বলা হয়, জামায়াতের পক্ষ থেকে আবদুর রাজ্জাককে তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি গণমাধ্যমকে না জানানোর অনুরোধ করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি তিনি অনুরোধটি রক্ষা করেননি।

একই নোটিশে মুজিবুর রহমানের বিষয়ে বলা হয়, তিনি কয়েক বছর থেকে সংগঠনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে ভিন্নমত প্রকাশ করে আসছিলেন, যা খুবই বিব্রতকর ছিল। একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে নিবৃত্ত করা যায়নি। সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনকে নিয়ে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা করেন। যদিও তাঁর এই উদ্যোগে সংগঠনের কঠিন দিনের সহকর্মীরা তেমন সাড়া দেননি।

ছাত্রশিবিরের সাবেক একজন সভাপতি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিশের বক্তব্য সাংঘর্ষিক। একদিকে জামায়াত বলছে, তারা নিজেরাই নতুন সংগঠন গড়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। আবার বলছে, নতুন সংগঠন গড়ার বিষয়ে জামায়াতের লোকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও তাঁরা তেমন সাড়া দেননি। সাড়াই যদি না দেন, তাহলে দায়িত্বশীলদের জরুরি নোটিশ পাঠিয়ে কোনো জনশক্তি যাতে সাড়া না দেন, সে ব্যাপারে কেন সবাইকে সতর্ক করতে হবে?

পদত্যাগপত্রে আবদুর রাজ্জাক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার বিষয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি জামায়াত। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

তবে জামায়াতের রাজনীতির অন্যতম পর্যবেক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত প্রয়োজনে আবার ক্ষমা চাইবে, নতুন সংগঠন করার জন্য তারা কাজ করছে।

তার মানে রাজ্জাকের পরামর্শই মেনে নেওয়া হচ্ছে—তাহলে তিনি পদত্যাগ করলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘তাঁকে তো কেউ বলেনি তাঁর পরামর্শ রিজেক্ট করা হয়েছে। বিষয়গুলো আলোচনায় ছিল। আমার বিবেচনায় তাঁর কাজটি ভালো হলো না।’

এদিকে আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পরপরই সংস্কার প্রস্তাব যাতে মাথাচাড়া না দেয়, দল থেকে বরখাস্ত করা হয় আরেক কেন্দ্রীয় নেতা মুজিবুর রহমানকে। এরপর ব্যাপক গুঞ্জন ছড়ায় যে জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ পদে থাকতে চাচ্ছেন না। কোনো কোনো অনলাইন পোর্টালে এ খবর বের হয়। এ বিষয়ে গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি তাসনীম আলম বলেছেন, মকবুল আহমাদের আমির পদে না থাকা বা পদত্যাগ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করার প্রশ্নই আসে না।