মুক্ত পরিবেশ ছাড়া মুক্ত সাংবাদিকতা করা যায় না

রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ

সংবিধানের ৩৯ ধারায় প্রদত্ত নাগরিকের অধিকার হলো স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও খবর প্রচার করা। খবরের ব্যাখ্যা এবং প্রকাশিত খবর ও মতের বিশ্লেষণ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য দরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরমতসহিষ্ণুতা। নাগরিকের এ অধিকার সংরক্ষণের জন্য মুক্ত পরিবেশ ও আইনি ধারামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এটা করার প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সরকারের।

মুক্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ না হলে মুক্ত সাংবাদিকতা করা যায় না। এমনিতে সংবিধানের ৩৯ ধারায় কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই শর্তগুলো (যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ) হলো, যেমন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সম্পর্ক বজায় রাখা, জননিরাপত্তা, নৈতিকতা ও আদালত অবমাননার বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।

সংবিধানের এসব শর্ত নিয়ে কোনো কথা বলছি না; কথা বলতে হয় যখন এই শর্তগুলো বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। বলা হতো, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবহারের সময় আইনটির অপপ্রয়োগ করা হয়। এই আইনের সুযোগে ভিন্নমতের অনেক সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ জন্য বলতে চাই, আইনের উদ্দেশ্য ভালো হলেও এর প্রয়োগ দোষে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনের কালো ধারা বাতিল করার জন্য আমরা সাংবাদিকেরা আন্দোলন করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত স্বৈরসরকার এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্র–সংক্রান্ত কালো ধারাগুলো বিলুপ্ত হয়।

এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবিধানের ৩৯ ধারার শর্তগুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে পুনর্জীবিত করা হয়েছে কুখ্যাত অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা। এ আইনটি এতই খারাপ যে এর প্রয়োগ না করেও সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করা যায়। বর্তমান প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক পরিবেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, খুলনায় নির্বাচনী ত্রুটির বিষয়ে খবর প্রচার করার জন্য দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাঁদের একজনকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে দেখা গেল, খবরটি ঠিক ছিল, যার মূল সূত্র ছিল সরকারি কর্মকর্তা। এখন সাংবাদিক দুজন জামিনে আছেন। কিন্তু গ্রেপ্তারের ঘটনা সাংবাদিকদের আতঙ্কিত করেছে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাকে সংকুচিত করেছে।

এ ছাড়া অনেক আইন দৃশ্যত খুব জনমুখী, কিন্তু প্রয়োগের সময় রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন সংবাদপত্র নিবন্ধন আইনের কথা ধরা যাক। এই আইনে দরখাস্তকারীর অধিকার সংরক্ষিত। দরখাস্তকারী রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতের হলে জেলা প্রশাসক প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদেরও পত্রিকা বের করার অনুমতি দেন না। আমার জানামতে এমন একটা বিষয় দেড় বছর ধরে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

বর্তমানে দেশে মতপ্রকাশের পথে আইনি বাধা খুব একটা না থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের হস্তক্ষেপে স্বাধীনতা খর্বিত হয়। তা ছাড়া, বৈরী পরিবেশের সুযোগে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরের প্রেশার গ্রুপের দৌরাত্ম্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। নির্বাচনোত্তর অনেক ঘটনার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রিত লেখালেখি হচ্ছে এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

সরকারকে যদি গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে হয়, তাহলে মতপ্রকাশের এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে আইনের শাসন ও সুশাসনকে ভুলে গেলে চলবে না।