অধিকাংশ হাসপাতালে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকা মহানগরের ৯৭ শতাংশের বেশি হাসপাতাল-ক্লিনিকে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। সেবাদানকারী এসব প্রতিষ্ঠানের অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণব্যবস্থা কয়েকটি অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক যন্ত্রের আবার মেয়াদও নেই। যন্ত্রের ব্যবহারও জানেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ঢাকা মহানগরের ৪৩৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিকে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণব্যবস্থা-বিষয়ক পরিদর্শন শেষে এই চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো হাসপাতাল-ক্লিনিকে পরিদর্শন শেষে এই তালিকা তৈরি করে। তালিকার তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরের এসব সেবাপ্রতিষ্ঠানের ৪০ শতাংশ আবার অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাকি ২ শতাংশ ভবনের ব্যবস্থা সন্তোষজনক।

সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগার ঘটনায় কয়েক শ রোগীকে আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে গত দুই বছরে চারবার চিঠি দিয়ে সতর্ক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে মাস তিনেক আগে একটি মহড়া হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা এ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া একবার চিঠি পেয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, যেগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব, তা করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার (২০১৭ সালের জানুয়ারি) পর মহানগরের ভবনগুলোর অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণব্যবস্থা সরেজমিনে দেখা হয়। তারপর সেসব ভবনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু হাতে গোনা দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি।

ব্যবস্থা বলতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ২ নম্বর মহিলা ওয়ার্ডে ৭০ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো রোগী বিছানায় শুয়ে আছে, কেউ করিডরে হাঁটছে। কেউবা বাইরে বের হতে বায়না ধরছে। এ ওয়ার্ডের নার্স স্টেশনে একটিমাত্র অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রয়েছে, যা মেয়াদোত্তীর্ণ। কর্তব্যরত তিনজন নার্স জানান, তাঁরা এই যন্ত্রের ব্যবহার জানেন না। কখনো মহড়ায় অংশও নেননি। হাসপাতালের ৩ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে কোনো অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র নেই।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৩ সালে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।
১৬ জানুয়ারি এই প্রতিবেদক রাজধানীর ১৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ঘুরে দেখেন। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সব কটি প্রতিষ্ঠানের চিত্র মোটামুটি একই রকম। কয়েকটিমাত্র অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র রাখা। সেগুলোর মেয়াদ নেই। মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসক-কর্মচারীরা এই যন্ত্রের ব্যবহার জানেন না। মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই জরুরি নির্গমন সিঁড়ি নেই।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, আগুন লাগার পর অনেক খুঁজেও ওয়ার্ডের আশপাশে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পাননি তিনি।

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহিত কামাল প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিনির্বাপণ ও প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্মাণাধীন নতুন ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পুরোনো ভবনে জরুরি নির্গমন সিঁড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না
অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণবিষয়ক ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাসপাতালগুলোকে কমপক্ষে চারবার চিঠি দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো সাড়া দেয়নি।
মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, হাসপাতালে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধানে উদাসীন। হাসপাতাল তৈরির সময়ও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সন্তোষজনক না হওয়ায় হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ফায়ার সার্ভিস থেকে লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) মো. আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার বিষয়টি আমলে নিয়ে নতুন তৈরি হাসপাতালগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি পুরোনো ভবনে এ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হবে। এর অংশ হিসেবে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপন, মহড়ার ব্যবস্থা করা হবে।

সন্তোষজনক চিত্র
ঢাকা মহানগরের মাত্র ১১টি হাসপাতালে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক। এর মধ্যে একটি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এই হাসপাতালে প্রতি ৫৫০ বর্গফুটের জন্য তিনটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, জরুরি নির্গমন সিঁড়িসহ নানা ব্যবস্থা আছে। এখানে দুই মাস পরপর মহড়ার আয়োজন করা হয়। পালাক্রমে সে মহড়ায় হাসপাতালের সব কর্মী অংশ নেন।