ফেরা না-ফেরা

আবদুল জব্বার
আবদুল জব্বার

গফরগাঁও থেকে ট্রেনে উঠে জব্বারের মনে হলো, যাত্রাটা দীর্ঘ হবে। ঘড়ির সময়ে যত না, তার থেকে বেশি মনের সময়ে। যদি তার যাত্রার সঙ্গী শাশুড়ি না হয়ে আমেনা হতো, এবং ছেলে বাদলকে কোলে নিয়ে কামরার কোনাটাতেও বসে থাকত, অনেক আনন্দে কাটত সময়টা। শাশুড়ি যে খুব কঠিন মানুষ তা নয়, তার সঙ্গ যে নিরানন্দ তাও নয়, কিন্তু তার শরীরে বাসা বেঁধেছে এক মরণ ব্যাধি। এ ব্যাধির চিকিৎসার জন্যই তাকে সে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকা। শাশুড়ির মনে ভয়, অনিশ্চয়তা। এ যাত্রা শেষ যাত্রা কি না, সে নিয়ে তার সংশয়ও। তিনি চুপচাপ বসে আছেন। তার নীরবতার ভার জব্বারকেও বইতে হচ্ছে। তার মুখেও কোনো কথা নেই।

অন্য যেকোনো যাত্রায় বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে আমেনা যখন দাঁড়ায় জব্বারের পাশে, হাতের হালকা স্পর্শে বিদায় জানায়, তার মনে হয়, উড়ে উড়েই গন্তব্যে যাবে আর ফিরবে। আমেনার তাকানোতে একটা মায়াময় ভঙ্গি আছে, তার হাসিতে থাকে একই সঙ্গে সাময়িক বিরহের বিষাদ আর ফিরে পাবার আনন্দ। তার সঙ্গ ভারী আনন্দের। কিন্তু আজ আমেনার চোখভর্তি পানি, যা ঢেকে দিতে পারেনি তার উদ্বেগ। আমেনা কাঁদছিল আর বলছিল, মাকে দেখে রেখো। যেদিন ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত হয়, আমেনা জব্বারকে বলেছে, ‘মা কি আর ফিরবেন? এই যাওয়াটা শেষ যাওয়া নয় তো?’ তারপর জব্বারের হাত ধরে বলেছে, মাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরতে হবে তাকে।

আমেনার ভয়টা অমূলক নয়, কিন্তু জব্বারকে শক্ত থাকতে হবে। আমেনাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না, ভয়টা তারও। ফিরবেন না মানে? জব্বার বলল, ‘আম্মাকে সুস্থ করেই ফিরব। ঢাকায় অনেক বড় ডাক্তার আছেন। তারা আরও কঠিন কত অসুখ ভালো করেন।’

আমেনার ভয়টা যায় না। হাসপাতাল তার কাছে এক ভীতির জায়গা। কেউ হাসপাতালে থাকবে শুনলে তার বুক কাঁপে। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে জব্বারকে সে বলেছে, ‘মাকে ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। কেমন?’

জব্বার বলেছে, ‘কোথাও যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

ট্রেন ছেড়ে দিলে শাশুড়ি সিটে এলিয়ে পড়লেন। যতটুকু আরামে তাকে রাখা যায়, জব্বার সেই চেষ্টা করল, তারপর চুপচাপ বসে ভাবতে থাকল। ঢাকা অচেনা শহর, কঠিন রোগের রোগীকে মেডিকেলে ভর্তি করা, ওষুধ–পথ্যের ব্যবস্থা করা, সর্বক্ষণ দেখশোনা করা সহজ কাজ হবে না। কিন্তু জব্বার এসব নিয়ে বেশি ভাবে না। পোড় খাওয়া মানুষ। ত্রিশের কোঠায় বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই দেশ-বিদেশের অনেক কিছুই দেখা হয়ে গেছে তার। জব্বারের মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। কত শখ ছিল পড়াশোনা করবে, ভালো চাকরি করে মা–বাবাকে দেখবে। কিন্তু তা আর হলো কই? অভাব–অনটনের সংসার। হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারল না। কিন্তু পড়াশোনা না করলেও জীবন তো অলস কাটিয়ে দেওয়া যায় না। একদিন শুধু মাকে জানিয়ে চলে গেল নারায়ণগঞ্জ। তার গ্রাম পাচুয়া পূর্বগ্রাম এমন এক ভূগোলের কোনায় পড়ে আছে, যেখানে কাজ মানে খেতে চাষ দেওয়া, না হয় কামলাগিরি করা। গ্রামের হামিদ মুন্সি তাকে বলেছেন, চাকরি করতে চাইলে ঢাকা যা, নেহাত না পারলে নারায়ণগঞ্জ। হয়তো পরিহাসের সুরেই কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু জব্বার নারায়ণগঞ্জের পথেই পা বাড়াল। মিললও চাকরি, এবং আরও মিলল নানান যোগাযোগে পরিচয় হওয়া জন হেপওয়ার্থের সাহায্য। হেপওয়ার্থ ইংরেজ, নারায়ণগঞ্জে এক জাহাজ কোম্পানির কর্মকর্তা। নারায়ণগঞ্জ থেকে চাটগাঁ-বরিশাল-ঢাকায় যাওয়া–আসা করে কোম্পানির লঞ্চ–স্টিমার। রমরমা ব্যবসা। হেপওয়ার্থ একদিন জব্বারকে বললেন, রেঙ্গুনে যাও। রেঙ্গুনে অনেক কাজ। বেতনও এখান থেকে অনেক বেশি।

জব্বারের কোনো ধারণা ছিল না রেঙ্গুন কোথায়, কোনদিকে। শুধু শুনছে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। তারপরও রাজি হয়েছে। রেঙ্গুন নামটার ভেতর একটা ঝংকার শুনেছে, সমুদ্রের একটা হাতছানিও পেয়েছে। বয়সটাও তার আঠারো পেরোয়নি। এই বয়সে মন উচাটন থাকে অদেখা–অজানার জন্য।

সেই যে রেঙ্গুন গেল, দশটা বছর আর ফেরা হয়নি। একটা অপরিচিত, বন্ধুহীন শহরে সে এত লম্বা একটা সময় কাটিয়ে দিল, আপদবালাই সব সামাল দিল। ঢাকা আর এমন কী কঠিন হবে তার জন্য?

আমেনাকে সে বলেছিল, ‘রেঙ্গুন থেকে তো ফিরেছিলাম, তাই না, এই পাচুয়াতেই ফিরতে অনেক বছর লেগেছিল, কিন্তু ফিরেছিলাম। ঢাকা থেকেও ফিরব, হয়তো সপ্তা দুয়েক লাগবে, অথবা একটু বেশি। তাতে কি।’

আমেনা স্বস্তি পেয়েছিল। চোখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলেছিল, ‘সেই দিনটার জন্য আমি বসে থাকব। এই দাওয়াটায়। পথের দিকে মুখ করে।’

ছেলেকে আদর করে, আমেনার গালে আঙুল বুলিয়ে সে পথে নেমেছিল।

২.

ট্রেনটা যখন ছাড়ে, এক যাত্রী কাতর কণ্ঠে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভাই, ট্রেনে ডাকাত উঠেনি তো!’

পঞ্চাশের শুরুতে গফরগাঁওয়ের বদনাম ছিল ট্রেনডাকাতদের কারণে, আর সুনাম ছিল এর বেগুনের জন্য। যাত্রীর কথা শুনে জব্বার হাসল। আবার একটু ভয়ও পেল। আশপাশে তাকাল। এক কঠিন চেহারার উঁচু লম্বা লোক বসে আছে তার উল্টা দিকে। ডাকাত নয়তো! চিন্তাটা অবশ্য উঠেই মিলিয়ে গেল। যাত্রী চোখ বুজে আছেন, হয়তো ঘুমিয়ে। জব্বারের ঘুম এলেও জেগে থাকতে হবে। শাশুড়ি যাচ্ছেন তারই পাহারায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে সুযোগ বুঝে কোথাও ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। তাদের প্রতিবেশী আব্দুল হাই ঢাকায় থাকেন, মেডিকেলের পাশেই ব্যারাকে। সেখানেই তার ওঠার কথা। তবে সব নির্ভর করছে ডাক্তার কী বলেন তার ওপর।

ঢাকায় ট্রেন থামলে শাশুড়িকে নিয়ে নামল জব্বার। অবাক কাণ্ড, ওই কড়া চেহারার যাত্রীই একটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শাশুড়ি ক্লান্ত, কিন্তু কেন জানি বেশ নির্লিপ্ত। হাসপাতালে যেতে যেতে তিনি জব্বারকে বলেছেন, কোনো চিন্তা না করতে। যা হবার তাই হবে। তিনি সব ছেড়ে দিয়েছেন ওপরওয়ালার হাতে।

জব্বারের হঠাৎ ধারণা হলো, তিনি হয়তো জীবনযুদ্ধটা আর চালিয়ে নিতে চান না। এ জন্যই এ রকম নির্লিপ্ততা।

হাসপাতালে শাশুড়িকে ভর্তি করে একটা বেড পেতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হলো। এক ভালোমানুষ ডাক্তার সাহায্য করলেন। তিনি বললেন, ‘বেড পাওয়া কঠিন। একটানা বেশি দিন ধরে রাখাটা আরও কঠিন। রোগীর যে চাপ।’

জব্বার বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা ফিরবে।’

ডাক্তার বললেন, ‘আসাটা নিজের ইচ্ছায়, যাওয়াটা নয়।’

শাশুড়ি মাথা নাড়লেন। ডাক্তারের কথা শুনে তার মনে হয়েছে, তার রোগটা জটিল, তা না হলে বেশি দিন থাকার কথাটা ডাক্তার কেন তুললেন। জব্বারকে বললেন, ‘আব্দুল হাইয়ের ওখানে গিয়ে রাতটা থাকতে। তিনি সারা রাত ঘুমাবেন।’

জব্বার কিছুতেই যেতে চায়নি, কিন্তু শাশুড়ি জোর করেই তাকে পাঠালেন। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কপালে ঘাম জমেছে। চোখ বুজে আসছে। এক নার্স খাওয়া নিয়ে এসেছে। একটুখানি খেয়ে তিনি ঘুমাতে গেলেন।

তার দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেল জব্বার। পাচুয়া কি তাহলে তাকে একা ফিরে যেতে হবে?

৩.

ঢাকায় নামছে একুশের সকাল। ঘুম থেকে উঠে জব্বারের অস্থির লাগল। গত রাতে সে স্বপ্ন দেখেছে। এলোমেলো আর টুকরো টুকরো স্বপ্ন। এক স্বপ্নজুড়ে একটা ট্রেন। একটা স্টেশনে আটকে আছে। টিটি লাল পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে। টিটির মুখটাতে হঠাৎ ওই ডাক্তারের মুখ যেন জেগে উঠল। ট্রেনটা ছাড়বে টিটির ইচ্ছায়। কিন্তু আপাতত সে রকম ইচ্ছা তার দেখা যাচ্ছে না।

ট্রেনটা আসার না ফেরার, জব্বার ঠাহর করতে পারল না। ব্যারাকে কাজ করে এক ছেলে নাশতা নিয়ে এসেছে। তাকে বলেছে, আজ অনেক গন্ডগোল হবে। রাস্তায় সে অনেক পুলিশ দেখেছে।

আব্দুল হাই তাকে গন্ডগোলের কারণ বলেছেন, পাকিস্তানিরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চায়।

‘আচ্ছা?’

‘তারা চায় আমরা উর্দু বলি। উর্দু সাচ্চা মুসলমানের জবান।’

জব্বার হাসল। রেঙ্গুনে অনেক সাচ্চা মুসলমান আছে। তারা কিচিরমিচির বর্মি ভাষায় কথা বলে।

‘এ কথাটা ওই পশ্চিমা পুলিশ কর্তাদের বুঝাও’, হাই বললেন। ‘তারা ইউনিভার্সিটি ঘিরে রেখেছে। ছাত্ররা আজ পথে নামবে।’

হাসপাতাল যেতে যেতে জব্বারের মনে উত্তেজনা হয়েছে। আমার জবান আমার, তোমারটা তোমার, সে ভেবেছে তোমারটা কেন চাপিয়ে দেবে? আমার বাংলা কী দোষ করল?

হাসপাতালে পৌঁছে অবশ্য জব্বার উত্তেজনা ভুলে গেল। শাশুড়িকে দেখে মনে হলো, বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন। সে খুঁজে পেতে ভালোমানুষ ডাক্তারকে শাশুড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। ডাক্তার জানালেন, ওষুধ দেবেন। কপালে থাকলে ভালো হতে পারেন, তবে সময় লাগবে।

অপারেশন লাগবে? হঠাৎ জিজ্ঞেস করল জব্বার। কথাটা অবশ্য আমেনার। আমেনা বলেছে অপারেশন যদি লাগে, তবে সেও ঢাকা যাবে। তার মা অপারেশন কথাটা শুনলেই ভয় পাবেন। জব্বারও অপারেশন পছন্দ করে না। তারও ছুরি–কাঁচি আর রক্তে দারুণ ভয়।

এখনই বলা যাবে না, ডাক্তার বললেন, ‘স্যার এলে তাকে জিজ্ঞেস করব। তিনি এগারোটায় আসবেন।’ শাশুড়ির পালস নিলেন ডাক্তার। জব্বারকে বললেন, ‘ভালো পথ্য দেবেন, দুর্বল হয়ে গেছেন।’

জব্বার ভাবল, গেটের কাছে ফলের দোকান থেকে কিছু ফল কিনে আনবে। শাশুড়ি কমলা পছন্দ করেন। ডাক্তার চলে গেলে সে শাশুড়িকে বলে গেটের দিকে গেল।

৪.

ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জব্বার শুনল, যেন এক খ্যাপাটে তুফান প্রচণ্ড শব্দে চারদিকে আছড়ে পড়ছে। গলায় ওই তুফানের আওয়াজ তুলে ছাত্ররা একটা মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাংলা ছাড়া ঠিকানা নাই’—এ রকম স্লোগানে মুখর সকালের আকাশে। কিছুক্ষণ মিছিলটাকে দেখল জব্বার, মিছিলের স্লোগান শুনল। আব্দুল হাইয়ের কথা মনে পড়ল। ছেলেগুলোর জন্য মায়া হলো তার, একটা রাগও জন্মাল। হাতে সময় আছে, কিছুদূর এদের সঙ্গী হলে কেমন হয়? রাগটা জানিয়ে দিয়ে আসা যায় অন্তত।

মিছিলের একটা ফাঁক খুঁজে তাতে পা রাখল জব্বার।

৫.

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জব্বারের শাশুড়ি অনেক শব্দ শুনেছেন, যেগুলো তার অপরিচিত। এক নার্স দৌড়ে এসে বলেছে, ‘গুলি চলেছে, গুলি!’ কিন্তু দুটি গুলি যে জব্বারের কোমরে, হাঁটুতে লেগেছে, শাশুড়ির তা জানার কথা নয়, তিনি চোখ বুজেই থাকলেন।

জব্বারেরও চোখ বোজা। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না সে। মিছিল এগোচ্ছিল, অজা​ন্তে তারও হাত ওপরে উঠেছিল। মুঠিবদ্ধ হাত। হঠাৎ অনেক শব্দ এবং তীব্র একটা কামড়। হাঁটুটা যেন গুঁড়িয়ে গেল। কোমরেও যেন কেউ বজ্র দিয়ে একটা আঘাত হানল। তার মনে হলো শরীরের তারগুলি সব যেন ছিঁড়ে গেল। ব্যথার আঘাতে সে যেন নুলো হয়ে গেল। পা ভেঙে পড়ে গেল। মিছিলের ছেলেরা তাকে তুলল, তারপর কাঁধে নিয়ে ছুটল। জব্বার চোখে আলোর কিছু নাচন দেখল। একটা ক্লা​ন্তি তার শরীরে ভর করল। অবচেতন চলে যাওয়ার আগে তার মনে হলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটারই কোথাও যেন সে আছে। তাকে ঘিরে অনেক মানুষ। ডাক্তার, নার্সের গলা শোনা যাচ্ছে। তাদের গলায় জরুরি ভাব। একজন বলল, এত রক্ত, বন্ধ করতে হবে।

তারই রক্ত? কেমন করে? কোথায়? সে শুনল, আরেকজন বলছে, ‘অপারেশন’। কথাটা শুনে তার আমেনার মুখ মনে পড়ল। তোমার অপারেশন হবে, সে শুনল আমেনা বলছে, আমি ঢাকায় আসছি।

একটা করুণ দুঃখ জাগল জব্বারের মনে। ট্রেনটা তো একটা ইস্টিশনে আটকে আছে। টিটির হাতে লাল পতাকা। ফেরার পথ নেই। আসার পথটাও বন্ধ।

‘ছেলেটাকে দেখে রেখো,’—সে মনে মনে আমেনাকে বলল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।