মানুষের তীক্ষ্ণ ইতিহাস

আবদুস সালাম
আবদুস সালাম

ভোরবেলা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে তকতকে মাঘ শেষের আকাশ, তাতে আঙুল মেলে দিয়েছে নিষ্পত্র শজনেগাছের এক গা সাদা ফুলঝুরি। বাতাসে ফাল্গুনের আমেজ নির্ভুল। এই সব সময়ে মাহবুব আর শ্যামলী, তোমরা ইশকুলে অমর-একুশের গানের শুরুতে যে হারমোনি করতে হয়, সেটা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মকশো করো। আশেক আর দীনা, তোমরা আর কদিন পরই আলপনা দেবে রাত জেগে। কিন্তু মোহছেনা আর রুহুল প্রায়ই ভাবে, আর বলেও ফ্যালে, ভাষাশহীদদের চেহারা এত ঝাপসা কেন, এমনকি তেলরঙেও। যেন তাঁরা ভিড়ের মানুষ, কররেখাহীন, কঠিন পদার্থের আকারহীন একরকমের আটপৌরে চেহারা—বিস্মৃতিতে বিলীয়মান আদল (বীরশ্রেষ্ঠদের অনেকেরও তাই)।

হয়তো এই জন্যই যে তাঁরা সত্যিই ভিড়ের মানুষ, কেউ সরকারি অফিসের পিয়ন, কেউ হাইকোর্টের কেরানি, কেউ বাদামতলীর প্রেসের মালিক, কেউ রিকশাওয়ালা, কেউ অমল বালক। ভাস্কর রাশা বর্ণনাভিত্তিক কল্পিত ছবি না আঁকলে এঁদের কারও কারও চেহারার ছবিই হতো না, এই যেমন শহীদ আবদুস সালাম, আমৃত্যু ৮৫ নং দিলকুশার ‘ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ’–এর রেকর্ডকিপার। চাকরিতে যোগদানকালে তোলা তাঁর একমাত্র ছবিটিও স্থানীয় নেতা খাজা আহম্মদের মৃত্যুর পর হারিয়ে যায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর ওঁর কোনো চেহারাই প্রচলিত ছিল না, চমকে উঠলে শ্যামলী? এই সব মাঘের আকাশ, নিষ্পত্র শজনেগাছ আর সাদা ফুলের মঞ্জরি দেখে উচ্চকিত হৃদয়ে বাতাসে আঙুল দিয়ে ‘ন-তু-ন’ লেখার বিলাস ছিল না নিশ্চয়ই তাঁর। তাই হয়তো ‘ন-তু-ন’ দিয়ে গেছিলেন।

নতুন দিলেন কোথায়? ভাষার অধিকার কি নতুন? সে তো চিরপুরাতন। মায়ের কোলে শিশুর নিত্যবিহারের মতো পুরাতন। তেমনি সৃষ্টির কোনো আদি ছন্দে নেচে নেচে লক্ষ্মণপুর গ্রামের কোনো এক দৌলতুন্নেসার কোলজুড়ে এসেছিলেন তিনি, শহীদ আবদুস সালাম। ওঁর বর্গাচাষী বাবার নাম মো. ফাজিল মিয়া শুনে হাসছ মোহছেনা, তোমারও কি নানির নাম দৌলতুন্নেসা কিংবা দৌলত বানু বলেছিলে একদিন? ১৯২৫–এর পাড়াগাঁয়ে তখন শীত পড়ে গেছে পুরোদমে। শ্যামদেশের রাজার অভিষেক হবার পরদিন কুয়াশায় ঘোরলাগা পুকুরে বালা পরা সরু হাতে ডুলিতে করে কি ছাইমাখা কাটা কৈ মাছ নাড়তে এসেছিল পৌর্ণমাসী দৌলতুন্নেসা, আর সব দিনের মতোই জলে ঝিকিয়ে উঠেছিল আলগা হয়ে যাওয়া আঁশের রুপোলি রেণু? ঠেলে উঠেছিল পরিষ্কার মাছের পিঠ, কোনো নয়া পয়গামের মতো। মাহবুব, আশেক আর রুহুল, তোমরা তো জানোই, বাইরের পৃথিবীতে তদ্দিনে মুসোলিনির সেই কুখ্যাত ভাষণটা দেওয়া শেষ, হিটলার ছাপিয়ে ফেলেছেন তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড, অক্সফোর্ড স্ট্রিটে লোকে দেখে ফেলেছে প্রথম টেলিভিশন। অত সব ডামাডোলের ভেতর আমার পূর্ব বাংলা তখনো সবুজ ডোবার মতো স্থির, সিঁধেল চোরের উৎপাত ছাড়া তেমন কোনো ঘটনা নেই সেখানে, গ্রামে ইশকুল নেই, ভোঁতা আকাশে নেই উড়োজাহাজ যাতায়াতের সরণি। মোগল আমলের দু-চারটি মসজিদ আছে, আছে গলাগলি করে থাকা কলাখেতের সারির ভেতরে মায়ের সিঁথির মতো সাদা সরু আলপথ, সেই পথ গেছে পাশের গাঁয়ে, রামানন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে আবদুস সালাম গুটি গুটি পায়ে গেলেন মাতু ভূইঞা করিমউল্যা বিদ্যালয়ে, তারপর দাগনভূইঞার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে—কামাল আতাতুর্কের নামে সেই হাইস্কুলের নাম। জ্বলজ্বলে সকালের আকাশে রোদের খেলা দেখে ভ্রু কুঁচকে সেখানকার ছাত্ররা-পল্লিবালকেরা আতাতুর্কের কথা কখনো ভাবত কি না, তা তো আমি বলতে পারি না শ্যামলী। অস্তিত্বসংকট যেখানে প্রতিনিয়ত শ্বাস ফ্যালে কাঁধে, জীবনসংগ্রাম যেখানে নিত্যদিনের, সেখানে কোন ঘুরপথে আদর্শ এসে ঢোকে রক্তে, তা আমি জানি না। ঢোকে নিশ্চয়ই, অযাচিত জীবাণুর মতো, পাকিয়ে তোলে বৈষম্যের ক্ষত, ঘনিয়ে তোলে বেদনা প্রতিটি অন্যায়ে। যা হোক, দীনা আর মাহবুব, তোমাদের প্রপিতামহের মতো করেই অভাব-অনটন এসে আবদুস সালামের কানে কানে শ্বাসের শব্দে বলেছিল ‘চরৈবেতি’, নবম শ্রেণির ছাত্র আবদুস সালাম বেরিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার দিকে, তদবির করে কাজ পেয়েছিলেন শিল্প-দপ্তরে।

বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন, ‘অবাক পৃথিবী’ আর ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’ দেখতে পাচ্ছিলেন সালাম, দপ্তরের অন্ধকার গহ্বরে লাফ দিয়ে পড়ে ঘাড় গুঁজে বাকি বেলা সাঙ্গ করাই হতো দস্তুর, কিন্তু মন যে বড় ঋজু, বাঁকা হতে চায় না এ মেরুরজ্জু কোনো অন্যায্যের প্রতি। সত্যি রুহুল আর মোহছেনা, আমিও ভাবি, চল্লিশের দশকের কোলকাতা ওঁর বুকে কি ঢেউ তুলেছিল উদ্দাম? কোনো চিঠি কিংবা ডায়েরি যদি থাকত! কে-ই বা লেখে, কাকেই বা লেখে... (এমন লোক, যাঁর কোনো ঝাপসা ছবি অব্দি নেই, থাকবে না মৃত্যুপরবর্তী পঞ্চাশ বছর)? কোনো আশ্চর্য স্মৃতিচিহ্নের মতো জ্বলজ্বল করছে না কিছুই। অতএব শুধু অপরাপর ছবি দেখে আমরাও ধরে নিই, রৌদ্রদগ্ধ কলকাতার জীবনে কোনো চলন্ত যানের পায়দানে লাফিয়ে উঠবার মতো করে চড়ে বসেছিল নওল কিশোর, গায়ে তার পানাপুকুরের স্তব্ধ সবুজ, চোখে বিবর্ণ শজনের ফুলঝুরি। একুশ বছর বয়সে সে প্রত্যক্ষ করেছে মানুষের প্রতি মানুষের প্রগাঢ় নিষ্ঠুরতা, রায়টের রক্তলোলুপ দিনগুলোতে পালিয়ে কোনোক্রমে বেঁচেছে সে।

ভারত-ভাগ হবার পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এলেন আবদুস সালাম; একদিকে পূর্ব পাকিস্তান, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান, মাঝখানে বিশাল ভূ–ভারত... মুসলমান উঠোনে ঢুকলে যারা হাঁড়িভরা ভাত ঢেলে ফেলে দিত—তাদের কাছ থেকে অবশেষে পৃথগন্ন হয়েছে বাঙালি মুসলমান। অথচ এই তরফের লোকে ভাতই খায় না, খায় রুটি, ঘুমপাড়ানি গান গায় আরেক ভাষায়, ফলায় আরেক ফসল, আদব–কায়দা আরেক রকম, সর্বোপরি সদর-অন্দর উভয়ে অসদ্ভাব আবার। হায় কপাল (বঙ্গে গেলে যে কপাল সঙ্গে যায়)! নিজভূমে আরও একবার অযাচিত বোধ করবার গাথা শুরু হলো। আবার রেকর্ডকিপারের কাজ নিলেন আবদুস সালাম, এবার চাচাতো ভাই আবদুল হালিমের সহায়তায়, ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ, ৮৫ নম্বর দিলকুশায়। থাকতেন ৩৬বি নীলক্ষেতের সরকারি ব্যারাকে। তদ্দিনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ রাজসিংহাসনে আরোহণ করেছেন, নীলক্ষেতে তখন অনেকগুলো কালো কালো তমালগাছের সারি ছিল, ছাব্বিশ বছর বয়সের যে টানটান যুবক সে পথ দিয়ে কাজে যেত—‘গা–খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু’ কি না কে জানত! কে জানত কোনো শাপলাপাতাবরণী উদাস কন্যা তাঁর বাগদত্তা ছিল কি না। তবে হ্যাঁ, আশেক আর দীনা, মোহছেনা আর রুহুল, তোমাদের মতোই তাঁর রক্ত ফুটত অন্যায় দেখলে। ডালপুরি ভাজতে ভাজতে যে ঢাকাইয়া লোকটা আবদুস সালামকে কুণ্ঠাজড়িত গলায় একদিন বলেছিল, ‘আমি ভি বাংলা চাই’, সে-ই পরে বলত—কেমন করে আবদুস সালামের চোখ জ্বলত অসহিষ্ণুতায়; ছোট চাকরি, হাতে সামান্য কটি টাকা রেখে বাকিটা পাঠিয়ে দিতেন আট-নয় সদস্যের বিশাল সংসারে... কিন্তু তাঁর স্পৃহা পরাস্ত হতো না কখনো, হাতায় করে ডালপুরির গায়ে গরম তেলের ফোস্কা ফেলতে ফেলতে প্রত্যক্ষদর্শী সেই লোকটা বলত, ‘আগ আছিল দিলে–দিমাগে তার!’ ‘আতিশখানা’ ছিল আবদুস সালামের বুকে, বলত লোকটা।

২১ ফেব্রুয়ারির বিকেল, ১৯৫২। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভ মিছিল করবার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হন আবদুস সালাম। উদ্দাম সেই মিছিলে কারা কারা শামিল ছিলেন, কারা ঝরে গেছিলেন, কোন পথ দিয়ে বের হয়ে সে মিছিল কোথায় গেছিল, তা তোমরা অনেক পড়েছ। তাই সে কথা থাক। এই মিছিলে মনশ্চক্ষে যখন আমি আবদুস সালামকে দেখি, তোমার মতো করে আমারও মনে হয় শ্যামলী, আতাতুর্কের নামে তাহলে নোয়াখালীর সেই সব উজ্জ্বল সকালে হাইস্কুলপড়ুয়া বালক-হৃদয় নির্ঘাত মথিত হতো, বড় বড় নাম দিশারি হয়ে উঠলেই মানুষ ভুলে যায় তার নিজের ঝাপসা চেহারা, ভুলে যায় বর্গাচাষির ভূমিহীনতা, ভুলে যায় টুক করে দপ্তরের অন্ধকূপে ঝাঁপ দিয়ে কোনোক্রমে জীবিকা নির্বাহ করাই জীবন। বৃহত্তর কল্যাণ তাকে ডাকে। ছাব্বিশ বছর বয়সের সর্বজয়ী শরীরে কী রকম দুন্দুভি বাজিয়ে তোলে তেমন তেমন সব ডাক। সে ডাকের কাছে আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়।

কেউ বলে, গোড়ালির ক্ষতে গ্যাংগ্রিন হয়ে দেড় মাস বেঁচে ছিলেন আবদুস সালাম, সে বছর ছিল লিপইয়ার, ৮ এপ্রিল ১৯৫২–এর দৈনিক আজাদ বলে, আবদুস সালাম মারা যান ৭ এপ্রিল বেলা ১১টায়। ‘বৃহত্তর কল্যাণ’–এর বিষয়ে সম্যকজ্ঞানহীন মো. ফাজিল মিয়া ছেলের জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন, ভেজা তমালগাছের মতো কালো কালো হয়ে গেছিল শবদেহটি। (১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে শহীদ আবদুস সালামের বাপকে হাজার দুয়েক টাকা দেয়, পরে দু–বান্ডিল ঢেউটিন। ঢেউটিনগুলো কাজে লেগেছিল, বসতভিটে গড়েছিলেন মো. ফাজিল মিয়া।) কেউ বলে, ধুত্তোর, ৪৮ বছর পর একুশে পদক দেবার সময় সনদে ভুল করে মৃত্যু দিবস মাস দেড়েক পরে লেখা ছিল, আসলে আবদুস সালাম মারা গেছেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। ‘প্রিয়তমদের মৃত্যুদিন থাকতে নেই’—এই সব বেফুজুল কথা বলে মৃত্যু দিবস না জানাটা ঠিক ঢাকা দিয়ে ফেলতে পারব আমরা। ঢাকা দিতে পারব এই তথ্যও যে আজিমপুর গোরস্তানে ভাষাশহীদ আবদুস সালামের কবরের সন্ধান পাওয়া যায় না।

লক্ষ্মণপুর গ্রামে শহীদ পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান সুবেদার আবদুল করিম শুধু বেঁচে আছেন। তাঁদের গাঁয়ের নাম ‘লক্ষ্মণপুর’ বদলে সরকারি গেজেটে রাখা হয়েছে ‘সালামনগর’। ‘লক্ষ্মণপুর’ নামখানা থাকলেও ভাষাশহীদের স্মারক জন্মস্থান হয়েই থাকতে পারত এ গ্রাম, তা আমি মানছি শ্যামলী। যা হোক, দিনকাল ভাল নয়, এ আলাপটুকু থাক। একুশে পদক একুশের শহীদদের কাছে পৌঁছতে অতগুলো বছর লাগল কেন, সে আলাপও থাক। সালামের নামে স্মৃতি গ্রন্থাগার আর জাদুঘর, স্টেডিয়াম আর মাইজদী সড়কে মাতুভূইঞা ব্রিজের কাছে ভাষাশহীদ সালাম গেট, মিলনায়তন আর জেলা পরিষদের কমিউনিটি সেন্টারও তাঁর নামে। নাম রেখেছি। বুঝলে মাহবুব আর শ্যামলী, আশেক আর দীনা, মোহছেনা আর রুহুল? তবে হ্যাঁ, ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ গাইবার সামান্য সময় তোমাদের গলাবন্ধ হয়ে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ঢোঁক না গিলতে পারার মতো করে বড় বিপ্রতীপে হয়তো মনে পড়বে, আমাদের আসলে স্মরণে নেই। শহীদের রক্তমাখা শার্ট আর সাদাকালো ছবির ট্রাঙ্কখানা সিঁধেল চোরে নিয়ে গেছে। ভেঙে গেছে ধুলোর ভিটিতে সেই ঢেউটিনের সামান্য সদন। তন্ময় কিশোর সকালের রোদে কার নাম ভেবে উত্তাপ পায়, যুবক কেন মিছিলে যায়—স্মরণে নেই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা আবদুস সালাম জানালার বাইরে তপ্ত মাঠ দেখে ছটফট করতে করতে দেড় মাস কী ভাবতেন—স্মরণে নেই। এই যে মশারির অন্তিমে অন্ধকারে ‘বউ’ বলে ডাকা, শীতের শুরুতে রাস্তায় ধুনকারের ‘লেপ তুষ্​ষোক’ ডাক, বিকেলের রাস্তায় ‘নোনতা বলো রে-এ-এ, এক হলো রে’ হাঁক... এই সব রক্তের দামে রয়ে যাবে, সেটা ভাবতেন? রইবে তো?