শফিউরের কোট

শফিউর রহমান
শফিউর রহমান

ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে একটা স্বচ্ছ কাচের বাক্সে রক্তের দাগমাখা একটা সাদা শার্ট আর একটা কালো কোট ঝুলছে। অনেক দিনের পুরোনো বলে রক্তের দাগটা কালচে হয়ে, হালকা হয়ে, কেমন যেন ম্লান মাটির রং ধারণ করেছে। শফিউর রহমান মাঝে মাঝে খুব নিঃশব্দে এখানে আসেন, কাচের বাক্সে ঢুকে জামাকাপড়গুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেখেন। তাঁর সেই বিশেষ দিনটির কথা মনে পড়ে। যেদিন সকালবেলা ঝটপট গোসল সেরে সাদা সুতি পায়জামার ওপর একটা সাদা গেঞ্জি আর সাদা রঙের এই হাফহাতা শার্টটা পরেছিলেন তিনি। যদিও সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ, ১৯৫২ সাল। প্রকৃতিতে ফাল্গুন মাস এসে গেছে, তবু ঢাকায় তখনো হালকা শীতের প্রকোপ ছিল, সাইকেল চালানোর সময় ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় বেশ শীত শীত লাগে, শফিউর তাই সাদা শার্টের ওপর এই কোটটা চাপিয়ে নিলেন। কালো রঙের সাধারণ একটা কোট। কোটের বাঁ পাশে পকেটের কাছটা কি একটু কুঁচকে আছে? ডান হাত দিয়ে চেপে ঘষে কুঁচকানো জায়গাটা সমান করার চেষ্টা চালালেন শফিউর রহমান। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার কালো চুলগুলো উল্টে পরিপাটি করে আঁচড়ে অফিসে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলেন তিনি।

আকিলা খাতুন ততক্ষণে রান্নাঘরের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে গরম ভাত, আলুভর্তা আর ডিম ভাজার সঙ্গে দুটো শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে শফিউর রহমানের সকালের খাবার সাজিয়ে ফেলেছেন।

শফিউর পা মুড়ে মাদুরে বসতেই তার তিন বছর বয়সী কন্যা শাহনাজ ছুটে এসে ধপ করে বাবার কোলের ওপর গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লে আকিলা খাতুন হা হা করে ওঠেন, ‘আরে, আরে, করো কী, বাবাকে খেতে দেও তো মা, চলে এসো আমার কাছে...।’

শফিউর এক হাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত তুলে স্ত্রীকে থামালেন।

‘অসুবিধা নেই আকিলা, ও থাকুক আমার কোলে, আমি ওকে কোলে নিয়ে দিব্যি খেতে পারব। কিচ্ছু হবে না।’

‘ওরে বাপসোহাগী মেয়ে রে, বাপ ছাড়া কিছুই বোঝে না...।’ আকিলা মুখ টিপে হাসেন। শফিউর চুপচাপ ভাত খান। মাঝে মাঝে কোলে বসা শাহনাজের মুখেও ছোট ছোট নলা করে ভাত তুলে দেন।

‘আজকে অফিসে না গেলে চলত না? কাল শুনেছি শহরে অনেক গন্ডগোল হয়েছে, গুলিতে মানুষ মারা গেছে।’ আকিলা খাতুন স্বামীর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন। ছয় মাসের পোয়াতি বউয়ের উদ্বিগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়া লাগে শফিউরের। নিজে পানি খেয়ে মেয়ের মুখেও পানির গ্লাসটা ধরেন তিনি। তারপর বলেন, ‘অফিসে জরুরি কাজ আছে, যেতেই হবে। চিন্তা কোরো না, তাড়াতাড়ি চলে আসব।’

বাসা থেকে বেরোবার মুখে শফিউরের বাবাও একই কথা বলেন। ‘কী দিনকাল পড়ল, কাল শুনলাম ছাত্রদের ওপরে পুলিশ গুলি করেছে। জিন্নাহ সাহেব কী এক আচানক কথা যে বলে গেল! আরে বাবা, বেশির ভাগ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেটাই তো রাষ্ট্রভাষা হবে। তা না, উর্দু উর্দু। ইন্ডিয়া ছেড়ে, বাপ–দাদার জন্ম ভিটা হুগলি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান চলে এলাম, কোথায় একটু শা​ন্তিতে থাকব বলে, তা না, এখানেও অশা​ন্তি।’

শফিউরের বৃদ্ধ বাবা মাহবুবুর রহমান আপন মনেই বকবক করেন। বাবার দুঃখটা শফিউর বোঝেন। শফিউরের জন্মও তো এই দেশে নয়, হুগলিতে, চব্বিশ পরগনা জেলার কোন্নগর গ্রামে, আইকম পাস করে আটচল্লিশ সালে ঢাকায় চলে আসার আগ পর্যন্ত তিনি তো কলকাতাতে গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজের ছাত্রই ছিলেন। কলকাতাতেই বিএ পড়ার ইচ্ছাও ছিল তাঁর। কিন্তু বাবা বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ, সেখানে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। তা ছাড়া ওখানে চাকরিবাকরিরও ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে। সব জায়গার মাটিই এক। নিজের ভাবলেই হলো।’

বাবার ইচ্ছাতেই শেষ পর্যন্ত স্ত্রী, কন্যা, মা আর ছোট চার ভাইকে নিয়ে শফিউরের ঢাকায় চলে আসা আর রঘুনাথ দাস লেনের এই বাড়িতে ওঠা। হ্যাঁ, একটা চাকরিও হয়ে গিয়েছিল শফিউর রহমানের, ঢাকা হাইকোর্টে, হিসাবরক্ষণ শাখায়, কেরানির চাকরি। প্রতিদিন সকাল দশটায় সাইকেলে চালিয়ে নবাবপুর রোড পার হয়ে হাইকোর্টের দিকে রওনা করেন শফিউর। বিকেল বেলা একইভাবে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। আজ, ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের সকালবেলাতেও পায়ে কালো জুতা জোড়া গলিয়ে, মেয়ে শাহনাজকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে মা–বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাইকেলে চড়ে হাইকোর্টে যাওয়ার জন্য বের হলেন শফিউর। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়েই কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক লাগল চারপাশ। ঢাকার রাস্তায় এমনিতেই কলকাতার চেয়ে মানুষজন কম। আজ যেন আরও বেশি খালি খালি লাগছে চারপাশ। গলির মোড়ের দোকানটাও আজ বন্ধ। রাস্তার পাশের কলতলাটাও খালি। কেমন একটা থমথমে, অস্বস্তিকর, গুমোট ভাব। হাইকোর্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি দূরে তো নয়, কয়েক সপ্তাহ ধরেই ছাত্রদের মিছিল, মিটিং, উচ্চকণ্ঠ স্লোগানের খবর কানে যাচ্ছিল শফিউর রহমানের। কাল তো শুনেছে, ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল করেছে। পুলিশ সেই মিছিলে নির্বিচার গুলিও চালিয়েছে, চার–পাঁচজন মারা গেছে। শফিউর রহমান সামনের দিকে চোখ রেখে ধীরেসুস্থে সাইকেলে প্যাডেল মারেন, সংসারে আরেকজন নতুন সদস্য আসছে। ছোট ভাইগুলো এখনো পড়ালেখা করছে, বাবাও ডাক বিভাগের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ফলে শফিউর নিজের চাকরিটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। কালকের অত বড় ঘটনার পর আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কী অবস্থা কে জানে? শফিউর রহমান একটা মোড় ঘুরে সাইকেল চালিয়ে রথখোলা নওয়াবপুর রোডে এসে ওঠেন। আরেব্বাস! এখানে তো অনেক মানুষের ভিড়! শফিউর সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন গতকালকের ঘটনার প্রতিবাদে এখানে বিক্ষোভ মিছিল করছে মানুষজন। ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এমনি সব স্লোগানে চারদিকে কান পাতা দায়। শফিউর রহমান মানুষের ভিড়ে সাইকেল ঠেলে হেঁটে সামনে এগোতে থাকে, আর এই সব মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ আর স্লোগানের অংশ হয়ে যান। শফিউর রহমানের মনে হয়, এই বিক্ষুব্ধ জনস্রোত তাঁকে ঠেলে, ভাসিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, তাঁর একজোড়া পা শত জোড়া পায়ে রূপান্তরিত হয়েছে, তাঁর কণ্ঠ শত কণ্ঠে চিৎকার করছে, তাঁর হাত আরও অনেক হাতের সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে।

তারপর হঠাৎ কয়েকটা গুলির কর্কশ শব্দ। শফিউর রহমানের পিঠে কেমন একটা প্রচণ্ড ধাক্কার মতো লেগেছিল। সাইকেল ছেড়ে কালো রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরনের কালো কোট আর সাদা শার্টটা ভিজে গিয়েছিল তাঁর বুকের লাল রক্তে। তখনো হয়তো প্রাণের সামান্য চিহ্নটুকু ছিল তাঁর মধ্যে, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছিল। চেতন আর অবচেতনের মধ্যখানে শফিউর রহমান ঝাপসা চোখে দেখছিলেন তাঁর বাবার মুখ, কন্যা শাহনাজ আর তাঁর অনাগত সন্তানের মা আকিলা খাতুনের কান্নাভেজা চোখ। ‘বাংলা ভাষা শোনো, তুমি শুধু ভাষা নও, তার চেয়ে বেশি কিছু। শোনো বাংলা ভাষা, মানুষের কান্না শোনো, তার ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা শোনো, আর স্বজন হারানোর বেদনা শোনো।’

ডাক্তাররা অপারেশন করেছিলেন বুলেটটা বের করে শফিউর রহমানকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু সেই অপারেশন সফল হলো না। ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা সব চেষ্টা বিফল করে দিয়ে মারা গেলেন শফিউর রহমান।

এবার তাঁর লাশের হস্তান্তর নিয়ে শুরু হয় আরেক নাটক। স্বাভাবিকভাবে আত্মীয়স্বজনের কাছে শফিউর রহমানের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয় না। যেন পুলিশের সত্যিই মনে হয়, ‘এই লাশের গন্ধ অন্য রকম। ওষুধের, গ্যাসের, রক্তের, বুলেটের গন্ধ ভরা এই লাশ।’ পুলিশ জানে, ‘এ মুর্দা কবরে থাকবে না, বিশ/ পঁচিশ/ ত্রিশ হাত, যত নীচেই কবর দাও এই মুর্দা কবর ভেঙে বেরিয়ে চলে আসবে। এরা জীবিত থাকতে দেশের আইন মানে নাই। মরণের পর পরপারের আইনও এরা মানতে চায় না। তাই এই লাশ বিপজ্জনক।’ ছাত্ররা এই লাশ নিয়ে মিছিল করতে পারে, যেকোনো মুহূর্তে আবারও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে পরিস্থিতি।

শফিউর রহমানের দাফন প্রসঙ্গে দুই রকম তথ্য জানা যায়। ১৫ মার্চ ১৯৫২ তারিখের দৈনিক আজাদ–এর প্রকাশিত সরকারি তথ্য বিবরণী অনুযায়ী, একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বাবা ও ভাইয়ের উপস্থিতিতে তাঁর জানাজা পড়ান, আর কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তাঁর কবর হয় আজিমপুর গোরস্থানে, আগের দিন পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষাশহীদ বরকতের কবরের পাশে।

আরেক সূত্র বলে, মেডিকেলের ছাত্ররা শফিউরের লাশ লুকিয়ে রেখেছিলেন, যাতে পুলিশ সেটি গুম করে দিতে না পারে। ২৪ তারিখ পর্যন্ত তারা এই লাশ লুকিয়ে রেখেছিলেন ঢাকা মেডিকেলের স্টেরিলাইজ ডিপার্টমেন্টে। তারপর ঢাকার এসডিওর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় আজিমপুর গোরস্থানে শফিউর রহমানের লাশ দাফন করা হয়।

ভাষা আন্দোলনের দুই শহীদ বরকত আর শফিউর এখনো পাশাপাশিই শুয়ে আছেন আজিমপুর গোরস্থানে। মাঝে মাঝে শফিউর জাদুঘরে যান, ঢাকা শহর ঘুরে আসেন। বরকত হয়তো জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন দেখলেন ভাই? মানুষ আমাদের কথা মনে রেখেছে?’

স্বল্পভাষী শফিউর কোনো উত্তর দেন না। তাঁর কন্যা শাহনাজ এখন অনেক বড় হয়েছে। তিন বছর বয়সী মেয়েটার মনে এখনো আবছাভাবে রয়ে গেছে বাবার স্মৃতি। ’৫২ সালের মে মাসে জন্ম নিয়েছে পুত্র শফিকুর। এই পুত্র কোনো দিনই তার পিতার মুখ দেখে নাই।