তরুণদের মুখে মুখে 'ফেসবুকীয় শব্দ'

ফেসবুক
ফেসবুক

‘ফ্রান্স, আই হ্যাভ এ কোশ্চেন’; ‘খেলা হপ্পে ফ্রান্স’; ‘ওকে ফ্রান্স’; ‘কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না ফ্রান্স’। রাজধানীর ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় একদল তরুণ-তরুণীর আড্ডায় বলা কথায় ঘুরেফিরে আসছিল ‘ফ্রান্স’ শব্দটি। কিন্তু ইউরোপের দেশ ফ্রান্সকে নিয়ে কথা বলছিলেন না তাঁরা। এই ফ্রান্সের অর্থ বন্ধু। ইংরেজি শব্দ ফ্রেন্ডসের সংক্ষিপ্ত রূপ।

‘ফ্রান্স’ শব্দের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক পর্যবেক্ষণ করে তরুণেরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করেন এমন কিছু বাংলা শব্দের সংক্ষেপিত রূপ পাওয়া গেল। যেখানে খারাপ শব্দের সংক্ষেপ হয়েছে ‘খ্রাপ’, বিনোদন হয়ে গেছে ‘বিনুদুন’, মন চায় হয়ে গেল ‘মুঞ্চায়’, পড়ি নাই হয়েছে ‘পড়িনাইক্যা’। অনলাইনের বাইরে যেগুলো আবার বাস্তব জীবনে কথা বলার সময়ও অনেকে ব্যবহার করছে।

ভাষাবিদ ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মনসুর মুসা বলছেন, প্রযুক্তির মাধ্যমগুলোতে ভাষার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যৎটা হয়তো এমনই হবে। কারণ, এটি ব্যাপকতা লাভ করছে। অনেকে এটিকে ফ্যাশন ধরেই এর চর্চা করছে। সাহিত্যেও লেখা হচ্ছে। কিন্তু এটি ভালো কিছু না। ভাষার বিকার ঘটছে এর মাধ্যমে।

অন্যদিকে বাস্তব জীবনে প্রচলিত কিছু বাংলা শব্দ নতুন অর্থ পাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। অনেক ইতিবাচক শব্দেরই অর্থ দাঁড়াচ্ছে নেতিবাচক। নেতিবাচক হচ্ছে ইতিবাচক। অর্থের এমন পরিবর্তন অনুসন্ধানে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন। প্রচলিত অর্থে ‘মাথা নষ্ট’ বলতে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনতা বোঝালেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই শব্দের ব্যবহার হয় কোনো কিছুর প্রতি সন্তুষ্ট বা বিস্ময় প্রকাশে। আবার ‘জটিল’ বলতে কঠিন কিছু বোঝালেও অনেকে ব্যবহার করছেন পছন্দনীয় অর্থে।

‘ভাষা ও ভোগ’ শিরোনামের ওই গবেষণায় অস্থির, সেই, জোশ, চরম, মাখন, অসাম, রুচি, ব্যাপক, প্যারা, লোল—এর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চিত ১৮টি শব্দের ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিবর্তনকে দেখিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী। ফরহাদ হোসেন বলেন, ইন্টারনেটে এখন ভাইরাল হওয়ার চল আছে। তাই প্রচলিত অর্থ যা–ই হোক, কোনো শব্দ ভিন্ন অর্থ বুঝিয়ে ভাইরাল হলেই সেটিকে অনেকে ওই অর্থেই ব্যবহার করতে শুরু করেন। একটা সময় বাস্তব জীবনেও কথা বলার সময় চলে আসে সেটি।

এমন শব্দের ব্যবহার শহুরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই বেশি। যেগুলোকে বলা হচ্ছে একান্তই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শব্দ। কিন্তু বাস্তব জীবনেও এর প্রয়োগ কেন?

 রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নিশাত তারানুম বলছেন,বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপগুলোতে কারও সঙ্গে বলা কথা দ্রুত লেখার জন্য শব্দের এমন রূপ দেওয়া হচ্ছে। যেমন ইংরেজি বর্ণে বাংলা “খারাপ” শব্দ লেখার সময় ছয়টি বর্ণ লিখতে হয়। কিন্তু “খ্রাপ” লিখলে শুধু “কেএইচআরপি” লিখলেই চলে। ইন্টারনেটে এগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছি। আবার বাস্তব জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করেও এগুলো বলছি। এতে বাস্তব জীবনেও একটি অভ্যস্ততা গড়ে উঠছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এক চায়ের দোকানের আড্ডায় বন্ধুদের মধ্যে কথা হচ্ছিল আগের দিন হলে গিয়ে দেখা চলচ্চিত্র নিয়ে। ‘তুই যত যা–ই বলিস মামা, ছবিটা কিন্তু মারাত্মক। একটু বেশিই জোশ।’ ‘দেখলাম তো ফেবুতে চেক ইন দিছস। আমার লগে যাইতে প্যারা খাইলা। পার্টের উপ্রে পার্ট নিলা।’ এই আড্ডার কথায় প্রচলিত বাংলা, ইংরেজি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়।

ভাষাবিদদের মতে, ভাষা নদীর মতো প্রবহমান। বাঁকে বাঁকে পরিবর্তন ঘটে। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চর্চা করা শব্দ প্রমিত বাংলাও না, আবার আঞ্চলিকও না। এই শব্দগুলো আবার শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নেই।

ভাষার এই চর্চা কতটা গ্রহণযোগ্য এবং করণীয় কী জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম দিয়ে ভাষার ব্যবহারকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা এই শব্দগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত, তাদের মধ্যেই যদি এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য কারও সঙ্গে প্রয়োগ করলে তা বিরক্তির সৃষ্টি করবে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ব্যবহারকারীদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।