পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি

ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা—সূচনা থেকে সফল পরিসমাপ্তি। এ আমরা সবাই জানি, কথাটা এক লবজে বলেও থাকি। কিন্তু যা ছিল ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, তা কী করে দুই দশকের মধ্যে একটি জাতির জাগরণ ঘটিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নিয়ে আসে! অবশ্য মাও সে তুং বলেছিলেন বটে, স্ফুলিঙ্গ থেকেই দাবানলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার তো একটা বিস্তৃত বহুমাত্রিক কাহিনিই থাকার কথা। সেটা জানা বাংলাদেশকে বোঝার ক্ষেত্রে জরুরি। সেই জরুরি কাজটা করেছিলেন রাজনীতি-সংস্কৃতির দক্ষ বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। তাঁর ম্যাগনাম ওপাস পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি নামের তিন খণ্ডের বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ আর শেষ খণ্ডের প্রথম প্রকাশের কাল ১৯৮৫।

‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রামাণ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বই লেখা দরকার’—এই বিবেচনা থেকেই বদরুদ্দীন উমর এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন, ‘এই আন্দোলনকে আসলে শুধু ভাষার আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা অথবা ব্যাখ্যা করলে সেটা সঠিক হবে না।’ কারণ শি​ক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি আন্দোলন কীভাবে কৃষক-শ্রমিকসহ গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে পৌঁছেছিল, সে ইতিহাস তো জানা প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তখনকার তরুণ বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বিস্তৃত পরিসরে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ১৯৪৮ থেকে সূচিত আন্দোলন এবং ’৫২-এর অগ্নিঝরা কয়েকটি দিন এবং তারপরে দেশের নানা প্রান্তে নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে সংগ্রামের পথে এসেছে, সে কথা তথ্য-প্রমাণসহ লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হলো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা ও বাঙালির মূল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেটি কেবল ভাষার আন্দোলনে সম্পন্ন হয়নি, এ দেশের মূলধারার রাজনীতি এবং কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-তরুণদের বিভিন্ন সংঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের অবদানও তাতে কম নয়। তিন খণ্ডের এ বইয়ে এসব কথা সবিস্তারে আছে। বইটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায় ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি থেকে বাঙালি কেন ও কীভাবে স্বাধীনতার দাবিতে এসে পৌঁছেছিল।

উমর নিজে বামপন্থী ধারার প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকলেও ইতিহাসের স্বার্থে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন। তাঁর বইয়ে ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন যুবলীগ নেতা অলি আহাদের প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের অল্প কয়েক বৎসর পর থেকেই রাজনীতিতে তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা শুরু হলেও তাঁর বর্তমান রাজনীতি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ঘৃণার্হ।’ কিন্তু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বইটির অনেকখানি তথ্যের জন্য বদরুদ্দীন উমর নির্ভর করেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সরকারের কান্ডারি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির ওপর।

ভাষা আন্দোলনের পরিণতি থেকে তাঁর উপলব্ধি, ‘ভাষা আন্দোলনের কোনো একক রাজনৈতিক নেতা ও নায়ক ছিল না। জনগণই ছিলেন তার প্রকৃত নায়ক।’ সেই সঙ্গে এই অভিমতও তিনি স্পষ্ট ভাষায় দেন যে, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন নিছক রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না।’ তত দিনে বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। কারণ, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনি দিয়ে তারা তো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের প্রত্যাশা থেকে। কৃষক ভেবেছিল তারা জমি পাবে, শ্রমিক ভেবেছিল কাজ পাবে ও বাঁচার মতো মজুরি পাবে, ছাত্রদের জন্য শিক্ষা হবে সুলভ, শি​ক্ষিত যুবকেরা পাবে চাকরি ও জীবিকার নিশ্চয়তা। ক্রমে বাঙালির অধিকার চেতনা প্রখর হয়েছে। তারা কেন্দ্রে সব​ ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহর অনমনীয় মনোভাব, লিয়াকত আলীর গোঁয়ার্তুমি, পাকিস্তানের অবাঙালি আমলাদের বাঙালিবিরোধী ভূমিকা, আর অন্যান্য পাকিস্তানি ও পাকিস্তানপন্থী বাঙালি রাজনীতিকদের দোলাচল ও আপসকামিতায় প্রথমে তারা আস্থা হারায় মুসলিম লীগের ওপর। মুসলিম লীগের এই জনবিচ্ছিন্নতার কারণেই এবং প্রধানত বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগের ফলেই মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ঘটে। উমর উল্লেখ করেন, ‘১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেই অবশ্য তাঁরা সকলে প্রথমে ধীরে এবং পরে দ্রুতগতিতে উপলব্ধি করলেন যে, যে স্বপ্ন পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে তাঁরা দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন তৎকালীন মুসলিম লীগ শাসনের দ্বারা বাস্তবে রূপায়িত হওয়া সম্ভব নয়।’ উমর বাঙালি মুসলমানের এই মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে দেশে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখায় বৈষম্য, বঞ্চনা এবং পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রসঙ্গগুলো উঠে এসেছে। আর বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে যেসব রূপান্তর ও পটপরিবর্তন ঘটেছিল, সেসব কথাও তুলে ধরেছেন। উমরের বিবেচনায় ভাষা আন্দোলনে সাংগঠনিকভাবে যুবলীগের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ ছাত্রদের দাবি গৃহীত হওয়ার পেছনে যুবলীগের সমর্থনই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। আর এই সাহসী কাজের ফলেই সেদিন পুলিশের গুলিবর্ষণ ও পরবর্তী প্রতিরোধ পর্যন্ত ঘটনা গড়িয়েছে।

উমর তাঁর অভিমত স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছেন তৃতীয় খণ্ডের সমাপনী অনুচ্ছেদে, ‘যেভাবেই দেখা যাক, এ কথা অনস্বীকার্য যে ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখ রাত্রি থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র ও যুবলীগ কর্মীরাই সাংগঠনিকভাবে সব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’ (পৃ. ৪৯৩)

উমর মনে করেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে কোন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিক না থাকলেও তার অপর একটি গণতান্ত্রিক দিক ছিল খুব স্পষ্ট। এবং সে দিকটি হলো তার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার দিক।’ (পৃ. ৪৯৭)

সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার ঘাটতিকে লেখক এ আন্দোলনের একটি দুর্বলতা হিসেবেই দেখেছেন। কথাটা সত্য হলেও এ আন্দোলনের ফলেই আমরা দেখি এ দেশে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন মূলধারার রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। আর সেভাবেই একসময় বাম প্রগতিশীলদের ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠে। এ রাজনীতি ধারণ করেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল।

পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে ও সাম্প্রতিক কালে উদ্ঘাটিত তথ্য-প্রমাণে বোঝা যায়, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির মুক্তির সম্ভাবনা যে কম, বিশেষ করে মুসলিম লীগের বাঙালি নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় এটা যে অসম্ভব, সেসব বিষয় বঙ্গবন্ধু প্রায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছু পর থেকেই উপলব্ধি করেন। আর তিনি যেহেতু বসে থাকার মানুষ ছিলেন না, তাই সে অনুযায়ী পদ​ক্ষেপও নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিকাশের দিক থেকে তাঁর সে ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে সেকালের অন্যান্য প্রধান আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা। ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলেও দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। উমরের লেখায় পাচ্ছি, ‘নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখে (১৯৫১) শেখ মুজিবুর রহমানকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময়ে কিছু রাজনৈতিক কর্মী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।’ (পৃ. ২১৪) এই ঘটনার বর্ণনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও আছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে।...আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে।...বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।’ (পৃ: ১৯৬) অলি আহাদের সাক্ষাৎকারেও এ ঘটনার বর্ণনা মেলে, ‘প্রহরী-পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি।’ (ব.উ. ২৪০, ফুটনোট)। এ প্রসঙ্গ একটু বিস্তারিতভাবে বলা এ কারণে যে তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতির নানা সংকটকালে বাঙালির স্বার্থের অনুকূলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা যে রেখে চলেছিলেন তা বোঝা যায়। বাংলাদেশের পরবর্তীকালের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে ভাষা আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আজ আরেকটু গুরুত্বসহকারে আলোচনার দাবি রাখে।

তবে এ কথা মানতেই হবে, বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি এ দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পথিকৃৎ দৃষ্টান্ত, এই ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি আকরগ্রন্থ, যার প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও বহাল রয়েছে।

● পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ৩ খণ্ড বদরুদ্দীন উমর, সুবর্ণ প্রকাশনী