বিদেশিদের আনন্দময় বাংলা শিক্ষা

শিক্ষক রূপা চক্রবর্তীর নির্দেশনায় বোর্ডে বাংলা লিখছেন অ্যাশলি রেটেগান। পেছনে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর লেখা দেখছেন অক্টাভিয়ান রেটেগান। তাঁদের ডানে নিজের মন থেকে আসা ভাবনা বাংলায় লিপিবদ্ধ করতে মগ্ন জেয়সন রবসন। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে।  ছবি: জাহিদুল করিম
শিক্ষক রূপা চক্রবর্তীর নির্দেশনায় বোর্ডে বাংলা লিখছেন অ্যাশলি রেটেগান। পেছনে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর লেখা দেখছেন অক্টাভিয়ান রেটেগান। তাঁদের ডানে নিজের মন থেকে আসা ভাবনা বাংলায় লিপিবদ্ধ করতে মগ্ন জেয়সন রবসন। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে। ছবি: জাহিদুল করিম
>

• ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিদের বাংলা শেখার ব্যবস্থা আছে
• ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে অল্প কিছু আগ্রহীই শেখার সুযোগ পান
• বিদেশিদের বাংলা শেখানোর ক্লাসগুলো হয় বেশ আনন্দঘন

সেদিন রোববার। সকাল থেকে আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। নগরে নামল বসন্তের প্রথম বৃষ্টি। তারই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে এলেন জেয়সন রবসন। প্রায় চার বছর ধরে ভেঙে ভেঙে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা শিখছেন তিনি। শিক্ষক যখন তাঁকে বোর্ডে একটি বাংলা বাক্য লিখতে বললেন, রবসন নির্ভুল বানানে ঝকঝকে হস্তাক্ষরে লিখলেন, ‘যদি আমি জানতাম আজ বৃষ্টি পড়বে, তবে আমি ছাতা নিয়ে আসতাম।’

সহপাঠীরা তো বটেই, শিক্ষকও প্রশংসায় ভাসালেন রবসনকে। কারণ, তিনি পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী থেকে মুখস্থ বাক্য লেখেননি। নিজে ভেবে পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা বাক্য লিখেছেন। এখানে বাংলা বিভাগের প্রধান রূপা চক্রবর্তী। তিনিই সবিস্তারে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশিদের বাংলা ভাষা চর্চার বিষয়ে।

নিউজিল্যান্ডের রবসন ছাড়া রোমানিয়ার অক্তাভিয়ান রেতেগান এবং যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাশলি রেতেগান এখন ডিপ্লোমা পর্যায়ের কোর্স করছেন। কিছুদিন আগেই সাতজনের একটি ব্যাচের সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে। নতুন কোর্সের জন্য ভর্তি শুরু হবে জুলাই মাসে। জুলাই থেকেই বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কোর্স শুরু হয়।

আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলাসহ ১৪টি ভাষা শেখানো হয়। এগুলোর মধ্যে বাংলা কেবল বিদেশিদের জন্য। জুনিয়র ও সিনিয়র সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা ও উচ্চতর ডিপ্লোমা—এই চারটি পর্যায়ে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। প্রতি কোর্সের মেয়াদ এক বছর। এ ছাড়া বাংলাদেশে গবেষণা বা ব্যবসার জন্য আসা বিদেশিদের জন্য তিন মাসের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স আছে। এতে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রয়োজনীয় বাংলা পরিভাষা এবং দরকারি কিছু বাক্য শেখানো হয়।

 গত প্রায় ২০ বছরে এখানে বাংলা শিখেছেন যেসব দেশের শিক্ষার্থী, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাপুয়া নিউগিনি, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, জার্মানি, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, রোমানিয়া ও রাশিয়া। তবে এ পর্যন্ত মোট কতজন বিদেশি শিক্ষার্থী এখান থেকে বাংলা শিখেছেন, তার মোট হিসাব পাওয়া যায়নি।

আনন্দ হয়, বিয়েও
বিদেশিদের বাংলা শেখানোর ক্লাসগুলো হয় বেশ আনন্দঘন। উচ্চারণ ও শব্দার্থ নিয়ে মজার মজার অনেক ঘটনা ঘটে। রূপা চক্রবর্তী বললেন, ‘চীনারা মাকে বলেন মামা। আমরা মামা বলি মায়ের ভাইকে। আমরা মামা বললে চীনা শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করে বলে ওঠেন, আমরা নাকি তাঁদের মাকে বদলে দিয়েছি—নারী থেকে পুরুষে। আবার ইংরেজিতে অল্পপ্রাণ ধ্বনি নেই, ফলে ব্রিটিশরা কাকাকে বলেন খাখা। তাতেও হাসাহাসি।’

ঘটনা আরও অনেক গভীর অবধিও গড়ায়। রোমানিয়ার যুবক অক্তাভিয়ান রেতেগানের নামের শেষাংশ মার্কিন অ্যাশলির নামের শেষে জুড়ে যখন অ্যাশলি রেতেগানে পরিণত হয়, তখন তাঁদের পরিণয় আর অজানা থাকে না। দুজনেই আলাদা করে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে এ দেশের মানুষের আন্তরিকতা, প্রকৃতি আর খাবারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আগ্রহ জন্মেছিল বাংলা ভাষা শেখার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তি হন চার বছর আগে। তারপর ভাষার প্রেম থেকে পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন তাঁরা।

অ্যাশলি এখন গর্ভবতী। তাঁদের মেয়ে হবে। তাঁরা দুজনই চান, মেয়ের জন্ম বাংলাদেশেই হোক। বাংলা বলায় ও লেখায় তাঁরা বেশ পারদর্শী। অক্তাভিয়ান গুনগুন করে ‘তুমি কোন পথে যে এলে’, ‘আমি বাংলার গান গাই’ গানের দু–একটি চরণ গেয়েও শোনালেন। এখন তাঁরা আছেন ছাত্র ভিসায়। আরও এক বছর এই ভিসাতেই উচ্চতর ডিপ্লোমা করবেন। তাঁদের ইচ্ছা, এরপর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশেই থেকে যাবেন বাকিটা জীবন।

ভর্তি–জটিলতা
ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখার ভর্তি প্রক্রিয়াটি খুব জটিল। ফলে প্রতিবছর যত শিক্ষার্থী বাংলা শিখতে আগ্রহী হয়ে আবেদন করতে চান, তাঁদের ১০ শতাংশের কম ভর্তির সুযোগ পান। এ বিভাগের কারণেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন হাতে গোনা, তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রসারে কার্যত তেমন ভূমিকাও রাখতে পারছে না এই প্রতিষ্ঠান। জানা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা শিখতে আগ্রহী বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব প্রদান, সরাসরি আবেদন গ্রহণ বা ভর্তির অনুমোদন দিতে পারে না। আগ্রহী শিক্ষার্থীকে আবেদন করতে হয় বাংলাদেশে তাঁদের দূতাবাসের মাধ্যমে। দূতাবাসের সেই আবেদন পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্র, শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষার পর অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। এই অনাপত্তিপত্রসমেত প্রার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে হয়। ২০০২ সাল থেকে জটিলতা আরও বেড়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক ও ভাষাবিদ অধ্যাপক মনসুর মুসা বললেন, এই জটিলতার সৃষ্টি পাকিস্তান আমলে। তারা ভাবত, বিদেশিরা বাংলা শিখে ভেতরের গোপন খবর জেনে যাবে। সে ভর্তি প্রক্রিয়া পরে আর সহজ করা হয়নি।