জন্মের সৌরভ

ওহিউল্লাহ
ওহিউল্লাহ

যেদিন অহির জন্ম হলো, সেদিন বাড়ির চারদিকের ছোট–বড় গাছে অনেক প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছিল। চাচাতো বোন মুন্নি রংবেরঙের প্রজাপতি দেখে আনন্দে মেতে ওঠে। আজ ওর স্কুল বন্ধ। সকালে মা ওকে বলেছে, আজ তোর স্কুল বন্ধ তো, ভালো হয়েছে। বাড়িতে থেকেই খবরটি পাবি।

‘কী খবর, মা?’

খোশনুর ওকে কোনো উত্তর না দিয়ে বলে, ‘দেখা যাক কী খবর হয়। যা, বাইরে বেরিয়ে খেলা কর গিয়ে।’

আজ বাড়ির বাইরে এসে প্রজাপতি দেখে মুন্নির মন ভালো হয়ে যায়। ও আনন্দে আত্মহারা হয়। এত প্রজাপতি একসঙ্গে দেখেনি। একটি প্রজাপতি ধরার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে। লেবুগাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একটিও ধরা হয় না। আখন্দ ফুলের ঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সেগুলোও এক মুহূর্তে উড়ে চলে যায়। বাড়ির চারপাশে কত ধরনের গাছ। অনেক গাছের নাম ও জানে না। মাঝে মাঝে বড় চাচা হাবিবুর রহমান গাছের নাম শিখিয়ে দেয়। এখন মনে হচ্ছে গাছের ওপর প্রজাপতি বসে থাকলে গাছগুলোর চেহারাই অন্য রকম হয়ে যায়।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে মুন্নি ভাবে, আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। ফুল-পাখি আঁকতে ভালো লাগে। নদী এঁকে পালতোলা নৌকা দিতে ইচ্ছে করে। ঘুড়ি এঁকে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারলে আমি আকাশে রংধনু দেখতে পাই। আবার আমার ঘুমপাড়ানি গান লিখতে ইচ্ছে করে। গল্প লিখে খাতা ভরিয়ে ফেলতে পারলে আমি আকাশে ওড়ানো ঘুড়ি হয়ে যাই। বাড়ি ফিরেই ও জানতে পারে, বাড়িতে নতুন অতিথি এসেছে। ওর একটি ভাইয়ের জন্ম হয়েছে। মুন্নি খুশিতে উঠোনে লাফালাফি করে।

রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমান আকিকা দিয়ে ছেলের নাম রাখে অহিউল্লাহ। মা তারাবানু ছোট্ট করে বলে, ‘ও আমার অহি। আমার আদরের অহি। সোনার টুকরো বাবা আমার।’

দিন গড়ায়। অহি বড় হতে থাকে। মুন্নি নিজেকে বলে, ‘অহি আমার সামনে প্রতিদিনের ভোরের আলো। ও আর কাঠপেনসিল দিয়ে ছবি আঁকবে না। ওকে রং-পেনসিল দিতে হবে। তাহলে ওর ছবিতে রঙের বাহার ফুটবে। ও ছবি এঁকে মজাই পাবে না শুধু, ছবি আঁকতে ভালবাসবে।’ তারপর চাচাকে ধরে ওর জন্য রং-পেনসিল আদায় করে মুন্নি। অহির ছবি আঁকার ভীষণ আগ্রহ। কাগজ আর রং-পেনসিল নিয়ে বসে যায় খেলার ফাঁকে। যত্ন করে আঁকে। পশুপাখি-প্রজাপতি-গাছ-ফুল এঁকে ভরায় ছোট ছোট কাগজ। ঠিকমতো আকার হয় না। অন্য রকম হয়। কিন্তু মুন্নি এই আঁকাতেও খুশি। ওর মনে হয়, এটা একটা নতুন রকমের ফুল কিংবা পাখি। অহি বলে, ‘আমি যা কিছু দেখি, তার সবকিছু আমার আঁকতে ইচ্ছে করে। আমার ছবি কি হয়, বুবু?’

‘হয়, হয়। তোমার ছবি তোমার মতো হয়। খুব সুন্দর হয়। তুমি আমাদের ছবির ছেলে।’

অহির হাসিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

একসময় স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়স হয় অহিউল্লাহর।

অহিউল্লাহ ভর্তি হয় প্রাথমিক স্কুলে।

দুই ভাইবোন অন্য রকম দিনের ছোঁয়া পায়। স্কুল, পড়ালেখা, ছবি আঁকা নিয়ে অহির সঙ্গে নানা খুনসুটিতে দিন কেটে যায় ওদের।

বছর গড়ায়। দুই ভাইবোনে বছরের হিসাব করে।

মুন্নি বলে, ‘আমাদের অহিউল্লাহ দশ বছরে পৌঁছে গেছে।’

‘আর আপনি কত বছরে, বুবু?’

‘জানি না। আমার কি আর আমার বয়স কত হয়েছে, তা মনে আছে! আমার মা–ও মনে রাখেনি।’

‘আপনি তো আমার বয়স লিখে রেখেছেন, বুবু।’

‘হ্যাঁ, আমার স্কুলের খাতায় লিখে রাখি। তুই যে আমার ছোট্ট ভাই। তোকে আমি অনেক আদর করি।’

এভাবে দুজনের দিন চলে যায়।

মুন্নি দশম শ্রেণিতে উঠেছে। অহিউল্লাহ তৃতীয় শ্রেণিতে।

মুন্নি একদিন শুনতে পায়, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবে না পাকিস্তান সরকার। সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করেছে। ওদের স্কুলে আসেন হালিমা আপা। তিনি ওদেরকে বলেন, ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। সবাইকে এই আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। মায়ের ভাষার মর্যাদা না থাকলে মানুষের মর্যাদা থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। আমরা আমাদের ভাষার অধিকার আদায় করে ছাড়ব।’

হালিমা আপা থামলে মেয়েরা স্লোগান দেয়, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

‘সাব্বাস, তোমরা আমাদের সাহসী মেয়ে।’

মুন্নি দাঁড়িয়ে বলে, ‘মিছিলে যেতে হলে আমাদেরকে খবর দেবেন, আপা। আমরা মিছিলে যাব। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসি। মায়ের ভাষার মর্যাদা চাই।’

আবার স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

হালিমা আপা বলেন, ‘তোমাদের সবার জন্য দোয়া করি।’

একজন মেয়ে প্রশ্ন করে, ‘আপা, কেন আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবে না পাকিস্তান সরকার? আপা আমাদের বুঝিয়ে বলেন, আমরা জানতে চাই।’

‘তোমরা সবাই তো জানো, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়?’

‘হ্যাঁ, আমরা জানি।’ মেয়েরা সবাই বলে।

‘এই বছরের শেষের দিকে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয় যে উদু​র্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে। আমরা বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে থাকি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। পাকিস্তানের সব প্রদেশের মধ্যে আমরা ছিলাম সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। অথচ সরকার আমাদের ভাষাকে একদমই উপেক্ষা করেছে। আমরা বাঙালিরা কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেব না। আমাদের ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। সে জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করেছি।’

মুন্নি বলে, ‘আমরা আমাদের মাতৃভাষার গৌরব চাই। আমাদের ভাষার অবহেলা হলে আমরা মানব না।’

হালিমা আপা আবার বলতে শুরু করেন, ‘করাচির শিক্ষা সম্মেলনের পরে ডিসেম্বর মাসের ছয় তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ সভা করে। সেদিন সভা শেষ করে মিছিল বের করা হয়েছিল। পরে সচিবালয়ের সামনে গিয়ে মিছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। সেদিন সবাই “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান দিয়েছিল। আরও একটি স্লোগান দিয়েছিল।’

‘কী স্লোগান, বলেন আপা? আমরাও ওই স্লোগান দেব।’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই দেবে। স্লোগানটি ছিল “উর্দুর জুলুম চলবে না, পাঞ্জাবি রাজ বরবাদ।”’

স্লোগান শুনে মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও স্লোগান দেয়। ওরা থামলে হালিমা আপা আবার কথা বলতে শুরু করেন।

‘তোমরা শুনে অবাক হবে যে পাকিস্তান সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপ করে বসে থাকেনি। তারা মানি অর্ডার ফরম, ডাকটিকিট এবং টাকায় ইংরেজি ও উর্দু ভাষা লিখে প্রকাশ করে। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় থেকেও বাংলাকে বাদ রাখে। এমনকি আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষেও তারা প্রচারণা চালাতে থাকে।’

‘আরবি হরফে বাংলা? বলেন কী আপা? আমাদের অ-আ থাকবে না?’

‘কেমন করে থাকবে? হরফ বদলালে আমাদের বর্ণমালা তো থাকবে না।’

‘অসম্ভব, এ হতে পারে না। আমরা হতে দেব না।’

‘ঠিক বলেছ। আমাদের সবাইকে এমন সাহসী হতে হবে।’

‘ভাষার প্রশ্নে আপস নাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

মুন্নি স্লোগানটি বানালে সবাই মিলে স্লোগান দেয়।

স্লোগান থামলে হালিমা আপা বলেন, ‘এরপর কী হয়েছে, শোনো। পরের বছর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। গণপরিষদের সদস্য ছিলেন আমাদের একজন বিশিষ্ট মানুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। গণপরিষদ পরিচালনার নিয়মকানুনে বলা ছিল যে গণপরিষদের আলোচনায় ইংরেজি বা উর্দু ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে বলেছিলেন, ইংরেজি ও উদু​র্র পাশাপাশি গণপরিষদের ভাষায় বাংলাকেও যুক্ত করা হোক। তাঁর এই প্রস্তাবে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি আরও বলেন, আমি আশা করি, গণপরিষদ এই প্রস্তাবকে বাতিল করে দেবে। শেষে বাতিল হয়ে যায়।’

‘ওরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে এমন করছে কেন?’

‘বাঙালিকে কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না ওরা। সে জন্যই ওরা শুরু করেছে এমন আচরণ। তবে আমরাও ছাড়ব না।’

‘হ্যাঁ, আমরাও ছাড়ব না।’

মেয়েরা স্লোগানের মতো বলে, ‘আমাদের কাছে ওদের মাফ নাই, বাংলা ভাষার মর্যাদা চাই।’

সেদিন দেরিতে স্কুল ছুটি হয়। বাড়িতে আসতে দেরি হয় মুন্নির। বাড়ির গেটে মুন্নিকে দেখে দৌড়ে আসে অহি।

‘বুবু আজকে দেরি হয়েছে কেন আসতে?’

‘আজকে আমাদের স্কুলে একজন আপা এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায় না পাকিস্তান সরকার।’

‘করতে চায় না? পাকিস্তান সরকার এত দুষ্টু কেন?’

‘দুষ্টু না, শয়তান। তুই দুষ্টামি করলে তোকে আমি দুষ্টু বলব, কিন্তু শয়তান বলব না। তুই শয়তান না।’

হি-হি করে হাসে অহিউল্লাহ! হাসতে হাসতে বলে, ‘চলো, শয়তান পাকিস্তান সরকারের ছবি আঁকি।’

‘কী আঁকবি?’

‘দৈত্যের মতো কতগুলো মুখ আঁকব।’

মুন্নি ওর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। অহি মুন্নির হাত ধরে বাড়িতে ঢোকে। মুন্নি ওর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, ‘আমি ভাত খেয়ে আসি। তুই বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে কাগজ-রং নিয়ে বোস।’

‘ঠিক, ঠিক। কাগজ আর রং, কাগজ আর রং—ছবি আঁকার মজার খেলা।’

অহি ছুটে নিজের ঘরে যায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। দুজনের ছবি আঁকা শেষ হয় না। দৈত্যের ছবি আঁকা শেষ হয় না ওদের। মা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসে। বলে, ‘ছবি আঁকা শেষ কর। এখন পড়ালেখা।’

‘ছবি আঁকা আমাদের শেষ হবে না। যত দিন দৈত্যগুলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবে না, আমরা তত দিন এই ছবি আঁকব। ছবি এঁকে পায়ের নিচে রাখব।’

মুন্নি গরগর স্বরে আরও বলে, ‘আজ থেকে ছবি আঁকা খেলা না। ছবি আঁকা হলো লড়াই। এই বারান্দায় বসে আমার আর অহির লড়াই।’

অহি মায়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলে, ‘মাগো, আমাদের স্কুলের টিচারও বলেছেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এই কথা আমাদেরকে বলতে হবে।’

বাংলাবাজার স্কুলে হালিমা আপা আরেক দিন আসেন। মেয়েরা তাঁকে ঘিরে ধরে বসে যায়। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কোন বছর চলছে, তোমরা কি জানো?’ সবাই একসঙ্গে বলে, ১৯৫২। মুন্নি দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনি বলেন, আপা। ভাষার জন্য আমাদের যা কিছু করার আছে, তা আমরা করব।’

হালিমা খাতুন মেয়েদের বলেন, ‘আমাদের সভায় ঠিক হয়েছে যে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাব। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাজেট অধিবেশন বসবে। সেদিন আমরা অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি পেশ করব।’

হালিমা খাতুন গলা উঁচু করে জোর দিয়ে বলেন, ‘সেদিন আমরা বিশাল মিছিল করব।’

একসময় স্কুল ছুটি হয়। মেয়েরা যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। আজ ওদের জন্য একটা অন্য রকম দিন ছিল। ভাষার জন্য যা কিছু করা দরকার, ওরা তা করবে। কেউ পিছিয়ে থাকবে না।

রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমান ২০ তারিখ বিকেলে বাড়ি এসে হাত-পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে পড়ে। খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে রাখে। তারাবানু কাছে এসে বলে, ‘কী হয়েছে?’

‘আমার কিছু হয়নি। কিন্তু আমাদের কারও জন্য খবর ভালো না। কালকে ছাত্রছাত্রীরা যেন মিছিল নিয়ে অ্যাসেম্বলি ভবনে যেতে না পারে, সে জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে।’

কাছে দাঁড়িয়ে ছিল অহি।

‘১৪৪ ধারা কী, আব্বা?’

‘আয়, আমার কাছে বোস। এই ধারা জারি করা মানে কেউ মিছিল নিয়ে রাস্তায় থাকতে পারবে না।’

‘কেন পারবে না? জোর করে নামা হবে। কী করবে ওরা? হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে বাধা দিতে পারবে?’

‘তখন মিছিলে গুলি করবে।’

‘গুলি? গুলি করলে তো অনেকে মরে যাবে?’

‘মরে যাওয়ার জন্যই তো গুলি করবে।’

‘ও মাগো। এটা কেমন কথা? ছাত্রছাত্রীদের গুলি করতে ওদের মায়া লাগবে না? ওরা কি এতই পাষাণ লোক, আব্বা?’

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অহি। ওর কান্না শুনে নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মুন্নি।

২১ তারিখে জমে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ।

চারদিক থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এসে জড়ো হয়েছে। আনুমানিক সময় সকাল ১০টা।

পুলিশ একসময় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে ছাত্রদের লাঠিচার্জ করে। ছাত্ররাও পুলিশের দিকে ইটের টুকরো ছুড়ে মারে। একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নি​ক্ষেপ করে। পুরো এলাকা সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হাবিবুর রহমানের হাতে তখনো একটি ইটের টুকরো ধরা আছে। পাঁচ-ছয়টি ছুড়েছে পুলিশের দিকে।

হাবিবুর রহমানের মাথার পাশ দিয়ে কয়েকটি গুলি ব্যারাকের বারান্দার পাশ দিয়ে বারান্দার বাঁশের চালায় গেঁথে যায়। হাবিবুর রহমান দ্রুত বারান্দার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে যায়। মুহূর্ত সময় মাত্র। পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করে। টের পায়, কেউ একজন ওর পাশে পড়ে গেছে। রক্ত গড়িয়ে আসছে। যে পড়ে গেছে, তার বাঁ ঊরুতে গুলি লেগেছে। অন্য দুজন ছাত্র এসে তাকে কোলে তুলে নেয়। আরও কয়েকজন ছাত্র এসে তাকে ধরে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। হাবিবুর রহমান টের পায়, সে রক্তের ধারা এসে ওর গায়ে লেগেছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে রক্ত দেখে। মুছে ফেলে না।

বিকেলের মধ্যে ওর জানা হয়ে যায়, যে ছাত্র শহীদ হয়েছে ওর সামনে, তার নাম আবুল বরকত।

পুলিশের গুলির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি আবার মিছিল বের করে ছাত্রছাত্রীরা। শহরের সাধারণ মানুষ যোগ দেয় মিছিলে। সরকারি কর্মচারীরাও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বিশাল মিছিলে নওয়াবপুর রোড ভরে যায়।

বাড়ির কাউকে কোনো কিছু না বলে অহি রাস্তায় চলে আসে। খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। কদিন ধরে ছোট ছোট কাগজে ছবি এঁকেছিল। প্রজাপতি, পশুপাখি এঁকে পকেটে রেখেছিল। মিছিলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে এক টুকরো ছোট কাগজ পকেট থেকে বের করে চিবুতে থাকে।

১৪৪ ধারা জারি আছে। ছুটে আসে পুলিশের গাড়ি। মিছিলে গুলি চালাতে শুরু করে। অহি খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ চিবুতে থাকে। ওর এই দশ বছরের জীবনে ও একসঙ্গে এত লোক দেখেনি। নিজের ভাষার জন্য জীবন দান করতে পারে মানুষ—এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কী হতে পারে—এমন ভাবনা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দু–চার লাফ দিয়ে ঘুরপাক খায়। দৌড় দিয়ে মিছিলে যুক্ত হতে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলি ছুটে আসে ওর দিকে।

একটি গুলি ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। পড়ে যায় অহিউল্লাহ। এর আগে নওয়াবপুর রোডে গুলিতে শহীদ হয়েছেন সফিউর রহমান। অহিউল্লাহর লাশ গুম করে পুলিশ।

তখন খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায় হাবিবুর রহমান। দেখতে পায় রেস্টুরেন্টের লোকজন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হাবিবুর রহমান চারদিকে তাকিয়ে ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে বলে, ‘আমার অহি কই? অহি? ও তো খোশমহল পর্যন্ত একা একা এসেছে। এই জায়গাটা ও চেনে। এর বেশিদূর আমি ওকে একা একা ছাড়িনি।’

কেউ কোনো কথা বলে না। হাবিবের দিকে তাকায় না। লোকেরা এদিক-ওদিক তাকায়। হাবিবকে আড়াল করে চোখের পানি মোছে।

হাবিব অস্থির হয়ে বলে, ‘অহি মিছিল দেখে চলে এসেছে বাড়ি থেকে। ও খোশমহলের এখানেই থাকবে মনে হয়। ও ছোট্ট ছেলে। আর কোথায়ই–বা যাবে? তোমরা কাঁদছ কেন?’

একজন মনে করে, ছেলের বাবাকে খবরটা বলা উচিত। যত কষ্টের খবরই হোক, বাবাকে তো জানাতে হবে।

মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘পুলিশ অহিকে মেরে ফেলেছে। ওর লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ।’

‘অহির লাশ? অহি লাশ হয়ে গেছে। ও আল্লাহ রে। পুলিশ ওকে কোথায় নিয়ে গেছে?’

অনেকেই একসঙ্গে বলে, ‘আমরা জানি না।’

হাবিবুর রহমান চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় বাড়ির দিকে। বাড়িতে কান্নার মাতম ওঠে। তারাবানু মাটিতে গড়াগড়ি করে। খোশনুর রান্নাঘরের দরজায় মাথা ঠোকে। মুন্নি কতক্ষণ কান্নাকাটি করে হাবিবকে বলে, ‘চাচা চলেন হাসপাতালে যাই।’

‘চল মা। আগে হাসপাতালে খুঁজে দেখি।’

দুজনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে হাসপাতালে। মর্গে অহির লাশ নেই। মুন্নি চেঁচিয়ে বলে, ‘ম-তে মর্গ। ম-তে মাতৃভাষা। যারা মাতৃভাষাকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছে, তাদের জন্য মর্গ। ওরে আমার প্রজাপতি ভাই। ছোট্ট ভাই। মাত্র দশ বছরে জীবন দিলি?’