উচ্চশিক্ষার ভাষা প্রসঙ্গে

১৯৫২  সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভা। ছবি: সংগৃহীত
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বাংলা ভাষাপরিস্থিতি নিয়ে আলাপ উঠলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাষামিশ্রণ বিশেষত বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণের সংকটের কথা বলা হয়। তুলনামূলক কম বয়সীদের ‘অপ্রমিত’ ভাষাভঙ্গির কথা বলা হয়। এগুলো যদি বাংলা ভাষার সংকট হয়ও, নিশ্চিত করে বলা যায়, খুব উপরিতলের বা গৌণ সংকট। কোনো জাতিরাষ্ট্রের ভাষা গভীর সংকটে পড়ে তখনই, যখন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বা বুনিয়াদি জায়গাগুলোতে তার ঠাঁই হয় না। এ রকম ক্ষেত্র মূলত তিনটি: দাপ্তরিক ব্যবহার, আইনি ব্যবহার এবং শিক্ষায় ব্যবহার। বাংলাদেশের অভিজাত দপ্তরগুলোতে বাংলার ব্যবহার বেশ কোণঠাসা; আদালতের কুলীন প্রাঙ্গণে বাংলার ব্যবহার এতই অচেনা যে কেউ একজন বাংলায় রায় লিখলে রীতিমতো প্রকাশযোগ্য সংবাদ হয়ে ওঠে; আর শিক্ষার ক্ষেত্রে বলা যায়, সচ্ছল মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরাও আজকাল আর বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না। এই শেষেরটিই অধিকতর বিপর্যয়কর; কারণ, এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠছে সেই জনগোষ্ঠী, যারা অন্য দুই প্রাঙ্গণে বাংলা ব্যবহারের এমনকি চিন্তাও করবে না। এসব গোড়ার আলাপ বাদ দিয়ে যাঁরা শাখা-প্রশাখায় বাংলা ভাষাপরিস্থিতির সংকট তালাশ করছেন, তাঁরা সত্য গোপনের দায়ে পড়ছেন কি না, ভাবার সময় এসেছে।

উচ্চশিক্ষায় বাংলার অবস্থা আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যথার্থ আয়না। আপনি বলতে পারেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলা আছে —অন্তত আংশিকভাবে; সংখ্যা হিসাব করে এমনকি এও বলা যাবে, অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বাংলা মাধ্যমে পড়ছে। শিক্ষার মাধ্যম বলতে আমরা বুঝব শ্রেণিক​ক্ষের ভাষা, উত্তরপত্রের ভাষা এবং পাঠ্যপুস্তকের ভাষা। সেদিক থেকে আমাদের এখানে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এবং মেডিকেলে কখনোই বাংলা ছিল না। যেমন ছিল না প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশক আগেও বেশির ভাগ বিভাগে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়া যেত; এখনো পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কেউ বাংলায় পরীক্ষা দেয় না। সামগ্রিক আবহের মধ্যে—বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের এবং বাইরের—একটা কার্যকর বিরোধিতা আছে। সুতরাং এ কথা প্রথমেই বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় আসলে বাংলা নেই। বাংলা আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারে না বলে বাংলা ব্যবহার করে। আসলে ওরা বাংলাও ব্যবহার করতে পারে না, যে অর্থে আমরা উচ্চশিক্ষায় বাংলা বা অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার বোঝাই। ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা পড়েছে থেকেও না থাকার সংকটে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন না হলে আসলে কোনো আলাপই কাজের দিক থেকে জমবে না।

উচ্চশিক্ষির এই পরিস্থিতিটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে দক্ষতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে সুবিধা করতে পারছে না—এ রকম একটা যুক্তিই আসলে আগে থেকেই ইংরেজি অবলম্বনের ন্যায্যতা তৈরি করে। বাংলাদেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণি আগে থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ত। প্রায় দুই দশক হয়ে এল, শিশু শ্রেণি থেকেই ইংলিশ ভার্সন চালু করেছে সরকার। ফলে বাংলা মাধ্যমে পড়ে কেবল তারা, যারা ইংরেজি কিনতে পারে না। রাষ্ট্র একটা শ্রেণিমূলক প্রতিষ্ঠান, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য অংশই কার্যত রাষ্ট্র চালায়। কাজেই যদি শিক্ষার মাধ্যমের ক্ষেত্রে শ্রেণিপ্রশ্ন আমলে না এনে কেবল সংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে সেটা খুব একটা কাজের হবে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোনো স্তরেই বাংলা নেই। এটাই বাস্তবতা। আর এই বিস্ময়কর বাস্তবতা তৈরি হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা অনেক দিন ধরে কীভাবে চলছে এবং কেন মনে হচ্ছে যে এতেই আমাদের কাজ চলছে। যে কথাটার ওপর জোর দিতে চাই তা হলো, দুনিয়ার কোনো দেশই আসলে অন্য ভাষায় শিখিয়ে উন্নতি করতে পারেনি। শুধু ভারতের কথা বলা যায়, যদিও ভারতের ভাষাপরিস্থিতি বাংলাদেশের ভাষাপরিস্থিতির সঙ্গে একবিন্দুও মেলে না। যাঁরা এ তুলনাটা করেন বা উদাহরণটা দেন, তাঁরা ভুল উদাহরণ দেন; কিন্তু বাংলাদেশে এই আলাপে সাধারণত ভারতের কথাই উচ্চারিত হয়, তার কারণ অন্য উদাহরণ আসলে খুব সুলভ নয়, যাঁরা দ্বিতীয় ভাষাকে শিক্ষার ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে উন্নতি করেছে। তাহলে এই যে বাংলাদেশে ইংরেজিটা চলছে, এটা চলতে পারছে কেন? চলতে পারছে তার কারণ, সোজা বাংলায়—আমরা আসলে শিক্ষাটা দিচ্ছি না।

কিন্তু এ কথারই বা অর্থ কী? শিক্ষা নাই মানে কী? তাহলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা করিটা কী? আমরা আসলে শিক্ষার নামে কিছু স্কিল সরবরাহ করি। স্কিল দিয়ে যে কাজ চলে আমরা ঠিক সেই কাজই করছি। ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রে এ কথাই বলা হয়েছে, এই উদ্দেশ্যের কথাই বলেছে। ওই কৌশলপত্রে শিক্ষার মাধ্যমের কথা একেবারেই আনা হয়নি। তার কারণ, এরা ধরে নিয়েছে, মাধ্যমটা ইংরেজি হয়েই আছে। আর ওই কৌশলপত্রে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করা।

তাহলে আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা যে চলছে বলে মনে করছি, তার প্রধান কারণ হলো, আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী সরবরাহ করছি, অথবা একেই প্রধান লক্ষ্য বলে সাব্যস্ত করছি। আর দেশের অভ্যন্তরেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লোক তৈরি করছে সেবা খাতের জন্য। কাজটাকে সরল করে বলা যায় পণ্য বিক্রির কাজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে চলছে মনে হয়, তার কারণও ওই একই। ওই ছাত্র-ছাত্রীরা বের হয়। শ্রেণিভিত্তির কারণে এবং সামাজিক যোগাযোগের কারণে সেবা খাতে কাজ পায়। এ দুটোই—দেশীয় সেবা খাতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মী সরবরাহ—আমাদের মূল লক্ষ্য বলে ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষায় কাজ চলে। এটা কোনো ‘এজুকেশন’ নয়, বড়জোর টেনেটুনে ‘ইনস্ট্রাকশন’।

উল্লেখ করা দরকার, আমাদের রাষ্ট্র আমাদের জ্ঞানে চলে না। বাংলাদেশে এমন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা নেই যা রাষ্ট্র চালানোর মতো জ্ঞান তৈরি করবে। আমরা আমাদের ফতোয়ায় রাষ্ট্র চালাই না। রাষ্ট্র চালানোর জন্য যাবতীয় প্রযুক্তি আমরা বিদেশ থেকে ধার করি। বিস্ময়কর নয়, এমনকি হয়তো আমাদের বাস্তবতায় লজ্জাকরও নয়—আমাদের ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্র বানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। শুধু শিক্ষা নয়, সব ব্যাপারেই আমরা রাষ্ট্র চালানোর প্রয়োজনীয় ‘জ্ঞান’ বা ফতোয়া বিদেশ থেকে ধার করি। ফলে আমাদের যে ‘শিক্ষা’ নাই তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হয় না। আরেকটা সত্য এই যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে মনে করে, বাংলাদেশে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যেতে হবে বিদেশে। ফলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়লে কাজটা একটু এগিয়ে রাখা যায়।

এসব কারণে মনে হচ্ছে, আমাদের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ভালোই চলছে। কিন্তু আসলে শিক্ষার বদলে আমরা শিখছি ‘মাধ্যম’। অর্থাৎ, ইংরেজিটাই শেখানো হচ্ছে, ইংরেজির মাধ্যমে কোনো ‘বিষয়’ নয়। ফলে কাজ চলছে। বিদেশে এবং দেশে সার্ভিস সেক্টরে। কিন্তু এ অবস্থা আসলে চলতে পারে না। আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে, দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা দরকার। বস্তুত করপোরেট অফিসগুলো চালানোর মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হয়ে উঠছে না।

যদি আমরা গুণসম্পন্ন শিক্ষা চাই, যদি জ্ঞান-উৎপাদক শিক্ষা চাই, যদি এমন শিক্ষা চাই যেখানে আমাদের উচ্চশিক্ষায় উৎপাদিত স্নাতকেরা কার্যকরভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র চালাবেন, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচে পালটাতে হবে। অনেকগুলো বড় পরিবর্তন করতে হবে। সেই পরিবর্তনের প্রথমটি হবে, সম্ভবত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য, এখনকার বাস্তবতার পরিপ্রে​ক্ষিতে বাংলার দিকে অল্প অল্প করে এগোতে হবে। কারণ, যেমনটি আগেই বলেছি, শিক্ষায় বাংলা আসলে নেই। নেই বলেই কোনো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিলে ভোক্তাস্তরে সম্মতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ধীরে ধীরে সামাজিক সম্মতি তৈরি করতে হবে; একই সঙ্গে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যবহারিক দিক থেকে প্রস্তুত করার কাজটাও সমানতালে চলবে।

কী কী উদ্যোগ নিতে হবে? বাংলা এবং ইংরেজিকে পরস্পরের বৈপরীত্যে স্থাপন করে আমাদের এখানে একটা সামাজিক কুসংস্কার জোরালভাবে জেঁকে বসে আছে, সেটা দূর করা হলো প্রধান কাজ। আমাদের প্রত্যেক সক্ষম বাবা-মা আসলে এটাই মনে করেন। এটা একটা সামাজিক কুসংস্কার এবং এর নিরসন ব্যক্তির কাজ নয়। ব্যক্তি যেকোনো কিছু মনে করতে পারে এবং তার প্রতি গণতান্ত্রিক কায়দায় শ্রদ্ধাশীল থাকতে রাষ্ট্র বাধ্য। রাষ্ট্রকেই নানাবিধ বাস্তব তৎপরতা নিয়ে বোঝানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে যে দুটি ভাষা আসলে কার্য​ক্ষেত্রে পাশাপাশি চলতে পারে। সারা পৃথিবীর মানুষ যে দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষা শেখে, দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষার এমনকি সৃজনশীল বা জ্ঞানজাগতিক ব্যবহার করে, এই বাস্তবতাটা সামনে আনতে হবে। বাংলাদেশের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতায় এটাই হবে প্রথম কাজ।

দ্বিতীয়ত, পাঠ্যপুস্তক তৈরি হবে এবং পরিভাষা তৈরি হবে— এজন্য একদিনও অপেক্ষা না করে উচ্চস্তরে বাংলা ব্যবহার শুরু করতে হবে। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, পরিভাষা আসলে বাংলা বা ইংরেজির বিষয় নয়। আমাদের শিক্ষাজগতের লোকজনের মধ্যেও এ বোধ খুবই দুর্লভ। আসলে পরিভাষা সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার। আর পরিভাষা তৈরি করবে সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনের চর্চাকারীরা, একেবারেই তাদের চর্চার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কাজেই পরিভাষা এবং ভাষার জন্য একবিন্দু সময় ব্যয় না করে আসলে শুরু করতে হবে আজই, আংশিকভাবে, যেহেতু হঠাৎ করে পুরোটা বাংলায় প্রবর্তন করা এখনই সম্ভব নয়। ক্রমাগত বাড়িয়ে, অল্পদিনের মধ্যে আমাদের এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে হবে, প্রাইভেট এবং পাবলিক সর্বত্র, যেখানে উচ্চস্তরের শিক্ষার্থীরা বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় লিখতে, পড়তে এবং পরীক্ষায় উত্তর দিতে পারবে। শুধু বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে এমন ছেলে-মেয়ে এবং বাঙালি বা বাংলাভাষী নয়, এমন শিক্ষার্থীদের এ প্রকল্পের বাইরে রাখা যেতে পারে। এর বাইরে বাঙালি বাবা-মায়ের ছেলেমেয়ে, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জন্মেছে এবং বড় হয়েছে, এদের​ ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে উচ্চশিক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজিকে কার্যকরভাবে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আগামী অনেক দিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত না আমরা বাংলাকে সরাসরি এককভাবে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করি। ফলে, আপাতত আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, উচ্চশিক্ষা শেষে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন দ্বিভাষিক দক্ষতা অর্জন করে।

তৃতীয় ধাপে যেতে হবে আরও অনেক দূর। আমরা যদি সত্যিই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে চাই, তাহলে আমাদের ঢুকতে হবে গবেষণা-স্তরে, আর সেই গবেষণাটা করতে হবে বাংলায়। এখানে আর একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি: সত্যেন বোস প্রমুখ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন বলে একটা কথা খুব চালু আছে। কথাটা ঠিক নয়। তাঁরা যেটা করেছেন তাকে বলতে পারি, বাংলায় বিজ্ঞানরস পরিবেশন করা। এটা অন্য ধরনের সাহিত্য মাত্র। একটা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা আর বিজ্ঞানরস পরিবেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা অ্যাকাডেমিক অর্থে কখনোই হয়নি। বিজ্ঞানীরা কখনো কখনো নিজেদের বা অন্যদের গবেষণার ফল সরলভাবে জনগণের জন্য প্রচার করেছেন। এটাকেই আমরা ভুলভাবে বলেছি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা। সত্যিকার বিজ্ঞানচর্চায় এবং কলা, বাণিজ্য ও সমাজবিজ্ঞানেও বাংলা ব্যবহারের জন্য উচ্চডিগ্রির সন্দর্ভে বাংলা আবশ্যিক করতে হবে। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা এবং বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে সন্দর্ভ রচনা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ নিশ্চিত করেই এটা করা সম্ভব। গবেষণা-সন্দর্ভ বাংলায় না লিখলে বাংলা ভাষার সেই আভিজাত্য এবং কার্যকরতা কখনোই সম্ভব নয়, যে আভিজাত্যের চাপে উচ্চ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত শিক্ষা-মাধ্যমের বাজে আলাপ চিরতরে নির্মূল হবে।