ভাষাহীনদের অনন্য ভালোবাসার বন্ধন

নির্বাক আড্ডায় মশগুল সবাই। তাঁরা সবাই সম্প্রতি পাবনা শহরের এলএমবি মার্কেটে।  প্রথম আলো
নির্বাক আড্ডায় মশগুল সবাই। তাঁরা সবাই সম্প্রতি পাবনা শহরের এলএমবি মার্কেটে। প্রথম আলো

চায়ের দোকান। নানা বয়সের বেশ কিছু মানুষ দুটি বেঞ্চে বসে ও দাঁড়িয়ে। চলছে জমিয়ে আড্ডা। হাসিঠাট্টা, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি। কিন্তু কোনো শব্দ নেই, নেই কোলাহল। কারণ, তাঁদের মুখে ভাষা নেই। সব হচ্ছে ইশারায়।

বাক্ ও শ্রবণশক্তিহীন এই মানুষগুলো ভাববিনিময় করেন ইশারাতেই। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা হয় না তাঁদের। হয় না ‘মা’ বলে ডাকা। তবে মা, মাটি ও মানুষের প্রতি পরম ভালোবাসা রয়েছে সবার। যে ভালোবাসার জোরে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ৫১ সদস্যের এক অনন্য পরিবার।

পাবনা জেলা শহরের এলএমবি মার্কেটে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেখা মেলে এই মানুষগুলোর। তাঁরা একত্র হন ইয়াকুব আলীর চায়ের দোকানে। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ান।

সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় দেখা হয় তাঁদের সঙ্গে। পরস্পরের ভাববিনিময় চলছিল। কেউবা মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন অন্য বন্ধুর। দু-তিনজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও চ্যাট করছিলেন অনুপস্থিত বন্ধুর সঙ্গে। সবই হচ্ছিল ইশারায়। কথা বলতে না পারলে কী হবে, জাতীয় সংগীত ও অমর একুশের গান সবার মুখস্থ। বাংলায় লিখতেও শিখেছেন। তাই লিখে লিখে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে আসে নানা গল্প।

২০০৬ সাল। শহরের আবদুল হামিদ সড়কের রায় বাহাদুর গেট। প্রথমদিকে দু-তিনজন সেখানে চা খেতে আসতেন। একপর্যায়ে বন্ধুত্ব হয় তাঁদের। তবে কাকে দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা মনে নেই। অপরিচিত কোনো বাক্-শ্রবণশক্তিহীন মানুষ দেখলেই চায়ের দোকানে আমন্ত্রণ জানাতেন তাঁরা। আপন করে নিতেন খুব সহজে। ফলে দু-তিন বছরের মধ্যেই দলটা বড় হয়ে ওঠে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা থেকে একত্র হন ২০ থেকে ২৫ জন। সময় পেলেই সবাই ওই এলাকায় এসে আড্ডা দিতেন, চা খেতেন। একপর্যায়ে সংখ্যাটা ৩০-৩৫ জনে দাঁড়ায়। তখন কিছু সমস্যা তৈরি হয়। মন খুলে ভাববিনিময় করতে পারতেন না। আবার অনেক সময় আশপাশের লোকজন বিরক্ত হতেন। ফলে নিরিবিলি একটা জায়গা খোঁজা শুরু হয়।

২০১১ সালে এলএমবি মার্কেটে নতুন চায়ের দোকান করেন ইয়াকুব আলী। ভিড় কম দেখে দলটি এসে ঠাঁই নেয় সেখানে। এরপর থেকে এখানেই বসছেন সবাই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে মিলিত হচ্ছেন। বর্তমানে ৫১ সদস্যের এক বড় পরিবার গড়েছেন তাঁরা। যে পরিবারে কিশোর, তরুণ, প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধ—সব বয়সীরাই আছেন।

তাঁদের এই বন্ধুত্ব দেখে মুগ্ধ শহরবাসী। তাঁদের মধ্যে কোনো দিন ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিযান দেখেননি বলে জানান মার্কেটের ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। যতক্ষণ সবাই একসঙ্গে থাকেন, হাসিমুখেই থাকেন বলে মন্তব্য তাঁর।

ভাই-বন্ধুর মতো মানুষগুলোকে আগলে রাখছেন চা বিক্রেতা ইয়াকুব আলী। লিখে লিখে এই মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান দলের প্রত্যেক সদস্য। সেই সঙ্গে লিখেই কিছু সমস্যার কথা জানান।

তবে নিজেদের বসার একটি নির্ধারিত জায়গা না থাকায় কষ্ট পান সবাই। তাই সরকারের কাছে একটি বসার জায়গা চান তাঁরা।

কথা বলা মানুষেরা তাঁদের ভাষাটা সহজে বোঝেন না। তাই মনের ভাব ব্যক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয় বলে জানান দলের সদস্য মো. আরেফিন। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। বর্তমানে পাবনার স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজে কাজ করেন। আরেফিন জানান, কাজে যতটা ক্লান্তি না আসে, তার চেয়ে বেশি ক্লান্তি আসে ভাববিনিময় করতে না পেরে। তাই প্রতিদিন বন্ধুদের কাছে ছুটে আসেন তিনি।