'খালি কেমিক্যাল কেমিক্যাল করতাছেন'

চুড়িহাট্টার আগুনে ছেলেকে হারিয়েছেন নাসিরউদ্দিন। ছেলের জন্য শোক প্রকাশ করে টাঙানো ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ছবি: দীপু মালাকার
চুড়িহাট্টার আগুনে ছেলেকে হারিয়েছেন নাসিরউদ্দিন। ছেলের জন্য শোক প্রকাশ করে টাঙানো ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ছবি: দীপু মালাকার

চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড় এখন বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যানজট নেই, রিকশার টুংটাং শব্দ নেই। ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ির ব্যস্ত ছুটে চলা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষ জড়ো হয়ে থাকা ছাড়া সেখানে নিত্যদিনের কোলাহলও নেই। এর আগে কখনো এ জায়গা এমন সুনসান ছিল কি না, কেউ মনে করতে পারেন না। মাত্র দুদিন আগে ভয়াল আগুন চুড়িহাট্টার চিরচেনা রূপ বদলে দিয়েছে।

গত বুধবার রাত ১০টার দিকে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সরকারি হিসাবে ৬৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। গত দুদিনে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাস্তার ওপর কয়লা বা ছাই পড়ে নেই। তবে পুড়ে কালো বর্ণ ধারণ করা দুটি যান্ত্রিক যান আর আশপাশের পুড়ে যাওয়া ভবন আগুনের ভয়াবহতার কথা জানান দিচ্ছে। কোলাহল নেই, জায়গায় জায়গায় লোকজন জড়ো হয়ে দুর্ঘটনা নিয়েই আলোচনা করছিলেন। মৃত্যু ছাপিয়ে তাঁদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল রাসায়নিক। দুর্ঘটনার জন্য রাসায়নিককে দায়ী করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।

আজ শনিবার চুড়িহাট্টার মোড়ে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নাজিমউদ্দিন, আবদুস সালাম, মো. করিমউদ্দিন, নাসিরউদ্দিনসহ কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দার। তাঁদের বয়স ৪০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিক গুদাম, প্রসাধন সামগ্রীর পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান ভাড়া দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন এই আগুনে স্বজন হারিয়েছেন। নাসিরউদ্দিন তাঁর একমাত্র ছেলে মো. ওয়াসিউদ্দিন মাহিদকে হারিয়েছেন।

নাসিরউদ্দিন ছাড়া বাকিরা এই দুর্ঘটনার জন্য রাসায়নিককে দায়ী করতে নারাজ। তাঁদের ভাষ্য, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই এ দুর্ঘটনায় রাসায়নিককে দায়ী করা যুক্তিহীন।তাঁরা বলেন, ‘কেমিক্যাল থাকলে পুরা চকবাজার সাফা হইয়া যাইত। গ্যাস সিলিন্ডারের লাইগা এইটা হইছে’। সাংবাদিকেরা দুর্ঘটনার জন্য রাসায়নিকের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন অভিযোগ করে তাঁরা বলেন, ‘আপনারা তো সত্য লিখবার পারবেন না। সত্য লিখলে তো আপনাগো চাকরি থাকব না। খালি কেমিক্যাল কেমিক্যাল করতাছেন। কেমিক্যাল ছাড়া কেউ বাঁচবার পারব?’

৭০ বছর বয়সী নাজিমউদ্দিন বলেন, কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা চুড়িহাট্টায় বসবাস করছেন। শত শত বছর ধরে চুড়িহাট্টায় জমজমাট ব্যবসা চলে আসছে। নব্বই দশকে এখানে প্রসাধন ব্যবসা শুরু হয়। তিনি দাবি করেন, এই এলাকায় কখনো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। একবার চুড়িহাট্টার মোড় থেকে বেশ দূরে ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল, তবে তাতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

এবারের আগুনের কারণ জানতে চাইলে নাজিমউদ্দিন বলেন, রাসায়নিকের কারণে নয়, গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে আগুন লেগেছে।

বডি স্প্রের মতো দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল—সে কথা বলতেই নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘কেমিক্যাল ছাড়া কেউ বাঁচবার পারব? কেমিক্যাল দিয়া কাপড়, সুগন্ধি, চশমা, জুতা তৈরি হয়। কেমিক্যাল ছাড়া কি দুনিয়া চলে?’

ওয়াহিদ ম্যানশনের ঠিক উল্টো দিকে একটি ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। ব্যানারে মো. ওয়াসিউদ্দিন মাহিদ নামের এক তরুণের জন্য শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এই তরুণের বাবা ওই বৃদ্ধ, নাম নাসিরউদ্দিন। চুড়িহাট্টার আগুন তাঁর একমাত্র ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। ছেলের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর দাফন করেছেন।

আগুনে প্রায় সব পুড়ে গেছে। এর মধ্যেও কিছু অক্ষত পাওয়ার আশায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খুঁজে চলেছেন এক তরুণ। ছবি: দীপু মালাকার
আগুনে প্রায় সব পুড়ে গেছে। এর মধ্যেও কিছু অক্ষত পাওয়ার আশায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খুঁজে চলেছেন এক তরুণ। ছবি: দীপু মালাকার

নাসিরউদ্দিন জানান, তিনি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। আগুনের ঘটনাটি উল্লেখ করতেই তিনি বলেন, এর একটি স্থায়ী সমাধান দরকার। পুরান ঢাকায় গৃহঋণ দেওয়া হয় না। তাই এখানের লোকজন বাধ্য হয়ে বাসার নিচে রাসায়নিক গুদাম, দোকান ভাড়া দেন। এতে এককালীন আট-দশ লাখ টাকা অগ্রিম পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গৃহঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বাসার নিচে রাসায়নিক গুদাম করা যাবে না মর্মে চুক্তি হতে হবে। তাঁর মতে, গৃহঋণ দেওয়া হলে কেউ বাসার নিচে দোকান, গুদাম ভাড়া দিতেন না

আগুন কীভাবে লেগেছিল—নাসিরউদ্দিনের কাছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক সব মিলিয়েই হয়েছে। তখন পাশ থেকে কয়েক যুবক বলে ওঠেন, ‘ চাচা, কেমিক্যাল না, সিলিন্ডারের লাইগা আগুন লাগছে।’

আজ শনিবার চুড়িহাট্টা পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সময় তিনি বলেন, চকবাজার থেকে রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকেও রাসায়নিক গুদাম সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

তবে মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর সেখানে বেশ কয়েকজন এর বিরোধিতা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁদের মতে, রাসায়নিকের কারণে আগুন লাগেনি। তাহলে কেন রাসায়নিকের গুদাম সরাতে হবে।

দুপুরের দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, এলাকায় যেসব বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম আছে, তা দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে। কোনো বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম পাওয়া গেলে সেই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মেয়র খোকন যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশ থেকে কয়েকজন বলছিলেন, ‘আগে সিলিন্ডার বন্ধ করেন। সিলিন্ডার বন্ধ করেন।’