রুদ্ধশ্বাস তিন ঘণ্টা

প্রায় তিন ঘণ্টার টান টান উত্তেজনার পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টা ঘটনার অবসান হলো আজ রোববার রাত সাড়ে সাতটার দিকে। কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছেন অস্ত্রধারী ওই ছিনতাইকারী। তবে বিমানের যাত্রী-ক্রুসহ সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

উড়োজাহাজটিতে থাকা একাধিক ক্রু ও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আকাশে ওড়ার পরপরই উড়োজাহাজটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। পুরো কাজটি করেন অস্ত্রধারী এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তি পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নিজের নাম ‘মাহাদি’ বলে উল্লেখ করেন।

একজন ক্রু জানান, সাড়ে চারটার কিছু সময় পর ‘ময়ূরপঙ্খী’ আকাশে প্রায় ১৫ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। তখন উড়োজাহাজের ভেতরে যাত্রীদের আসনে থাকা এক ব্যক্তি উঠে ককপিটের দিকে আসেন। এ সময় ওই ব্যক্তি এক ক্রুর কাছে যান। কাছে গিয়ে তিনি ওই ক্রুকে ধাক্কা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি পিস্তল ও বোমাসদৃশ একটি বস্তু বের করে বলেন, ‘আমি বিমানটি ছিনতাই করব’। আমার কাছে পিস্তল ও বোমা আছে। ককপিট না খুললে আমি বিমান উড়িয়ে দেব।’ এর মধ্যে অন্য কেবিন ক্রুরা ককপিটে থাকা পাইলট ও সহকারী পাইলটকে গোপনে সাংকেতিক বার্তা দেন যে উড়োজাহাজে অস্ত্রধারী আছে, উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক এ সময় উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম ও ঢাকার মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছিল।

ওই ক্রু বলেন, এর মধ্যে পাইলট মো. শফি ও সহকারী পাইলট মো. জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামগামী উড়োজাহাজটির ককপিটের দরজা বন্ধ করে দেন এবং কৌশলে জরুরি অবতরণের জন্য চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে বার্তা পাঠান। উড়োজাহাজে থাকা একটি সূত্র জানিয়েছে, ককপিটের দরজা না খোলায় অস্ত্রধারী ব্যক্তিটি চিৎকার করছিলেন। একপর্যায়ে ওই অস্ত্রধারী উড়োজাহাজের ভেতরে ‘বিস্ফোরণের’ মতো ঘটান। ততক্ষণে উড়োজাহাজটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ অবতরণের পর কৌশলে উড়োজাহাজের ডানার পাশের চারটি ইমারজেন্সি গেট দিয়ে যাত্রীরা নেমে পড়েন।

‘ময়ূরপঙ্খী’ উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, আর্মড পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একযোগে কাজ শুরু করেন।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানায়, উড়োজাহাজটি থেকে যাত্রী ও ক্রুরা বেরিয়ে গেছেন। অস্ত্রধারী উড়োজাহাজের ভেতরেই ছিলেন। তাঁর কাছে কী ধরনের অস্ত্র আছে কিংবা গোলাবারুদ আছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। নতুন উড়োজাহাজটিকে রক্ষা করাই প্রধান কাজ। উড়োজাহাজটিকে অক্ষত রেখে অস্ত্রধারীকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটির প্রধান মফিজুর রহমান রাত আটটার দিকে বিমানবন্দরের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ২৫-২৬ বছর বয়সী অস্ত্রধারী একজনকে আটক করা হয়েছে। যাত্রী-ক্রু সবাই সুস্থ আছেন। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ওই অস্ত্রধারীর দাবি-দাওয়া কী ছিল? এ বিষয়ে মফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইল তিনি সরাসরি উত্তর দেননি। তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আজকের এই ঘটনা মনিটরিং করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এর কিছুক্ষণ পরই চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান। তিনি জানান, কমান্ডো অভিযানে অস্ত্রধারী ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

এস এম মতিউর রহমান বলেন, দুঃখজনক একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল, এর অবসান হয়েছে। কমান্ডো বাহিনী আট মিনিটের মধ্যে অভিযানটি সম্পন্ন করে। অভিযানটি এত দ্রুত সময়ের মধ্যে সফলভাবে শেষ হয়েছে যে এর নামও দেওয়া যায়নি। ছিনতাইকারীর নিজের নাম বলেছে ‘মাহাদি’। বয়স ২৫। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁর কাছে একটি পিস্তল ছিল। তাঁর দাবি ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান

এ ঘটনার সঙ্গে কোনো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না? জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। প্রধানমন্ত্রীর আজকের চট্টগ্রাম সফরের সঙ্গে বিমান ছিনতাই চেষ্টার সংশ্লিষ্টতা আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

কমান্ডো অভিযান নিয়ে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ২৫-২৬ বছর বয়সী অস্ত্রধারী তরুণকে আটক করা হয়। পরে তিনি মারা যান।

বাংলাদেশ বিমানের নতুন উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খী ১৪২ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু নিয়ে ঢাকা থেকে দুবাইয়ে রওনা দেয় আজ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যায় উড়োজাহাজটি। চট্টগ্রাম হয়ে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজটি বিজি-১৪৭ ফ্লাইট হিসেবে দুবাই যাচ্ছিল।
বাংলাদেশ বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে, ১৬২ আসনের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজে ইকোনমি ক্লাসে ১৩৩ জন ও বিজনেস ক্লাসে ৯ জন যাত্রী ছিলেন। এ ছাড়া ৫ জন ক্রুর মধ্যে ২ জন নারী ছিলেন। ককপিটে ২ জন পাইলট ছিলেন। উড়োজাহাজটি ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্ত করা হয়।