মৃতপ্রায় তুলসীগঙ্গার প্রাণ ফিরবে

মৃতপ্রায় তুলসীগঙ্গা নদী। কচুরিপানার চাদরে ঢেকে গেছে। গতকাল নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
মৃতপ্রায় তুলসীগঙ্গা নদী। কচুরিপানার চাদরে ঢেকে গেছে। গতকাল নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তুলসীগঙ্গা নদী একসময় ছিল স্রোতস্বিনী। কিন্তু বছরের বছর ধরে দখল আর দূষণের শিকার নদীটি এখন মৃতপ্রায়—পরিণত হয়েছে সরু খালে। তা–ও আবার ঢেকে গেছে কচুরিপানার চাদরে। তবে নদীটির প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তুলসীগঙ্গার উৎপত্তি দিনাজপুরের শালখুড়িয়া ইউনিয়নের বিলাঞ্চল এলাকায়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, এর দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার। নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর এলাকায় ছোট যমুনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। নওগাঁ সদর উপজেলায় এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। ১৯৮৭ সালে সদর উপজেলার ছিটকিতলা এলাকায় জলকপাট নির্মাণ করা হয়। ওই এলাকায় তুলসীগঙ্গা থেকে একটি খাল খনন করে তুলসীগঙ্গার প্রবাহ ছোট যমুনার সঙ্গে মিলিত করা হয়। মূলত সেই সময় থেকেই তুলসীগঙ্গা নাব্যতা হারায়। প্রায় ৩০ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে দু-তিন মাস প্রবাহ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে এটি প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও পানি শুকিয়ে শুষ্ক মাঠে পরিণত হয়। ওই সব স্থান দিয়ে লোকজন হেঁটে নদীটি পার হয়। নদীর তীরবর্তী এলাকায় চালকলের ছাই, পৌরসভার পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালিসহ সব ধরনের বর্জ্য ফেলা হয় তুলসীগঙ্গায়।

গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, পৌরসভার রজাকপুর এলাকায় তুলসীগঙ্গা সেতু দুই পাশে নদীজুড়ে যেন ময়লার স্তূপ। সেতুর নিচে প্রচুর বর্জ্য ফেলা হয়েছে। তা ছাড়া নদীটি কচুরিপানায় ঢেকে আছে। কিছু কিছু স্থানে পানি নেই। লোকজন হেঁটে পারাপার হচ্ছে। সেতুর উত্তর দিকে তুলসীগঙ্গার উজানে পশ্চিম পাশে পাড়ে তিনটি চালকল আছে। এসব চালকলের ছাই ফেলা হচ্ছে নদীতে। এ কারণে ছাইয়ের স্তূপ জমে আছে। পূর্ব পাশে ভাটির অংশে পাড় ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে দুটি চালকল, দুটি ইটভাটা, চাল-গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য ছাঁটাইয়ের একটি কারখানা। সেগুলো থেকেও প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। তা ছাড়া পৌরসভার ভবানীপুর, কাঁঠালতলি ও রজাকপুর এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ির, কারখানার, নর্দমার ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি এসে পড়ছে নদীতে।

তুলসীগঙ্গার তীরবর্তী পৌরসভার কাঁঠালতলি এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন, সোহেল ও আবদুস সামাদ বলেন, এই নদীতে একসময় সারা বছর নৌকা চলত। নৌকায় করে মানুষেরা কৃষিজাত পণ্য স্থানীয় বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে যেতেন। কম খরচে মালামাল পরিবহন করা যেত। কিন্তু এখন বর্ষার সময় দু-তিন মাস ছাড়া পানিই থাকে না।

স্থানীয় রজাকপুর এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জহির উদ্দিন মণ্ডল বলেন, আগে তুলসীগঙ্গার পানি টলমল করত। আর এখন এখানে পানিই থাকে না। নিচু জায়গাগুলোতে পানি দেখা গেলেও ময়লা-আবর্জনার কারণে কালো দেখা যায়। দুর্গন্ধ ছড়ায়।

নওগাঁর তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনা নদী বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেহমুদ মোস্তফা বলেন, ‘একুশে পরিষদ ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার দখল-দূষণ দূর করে প্রবাহ স্বাভাবিক করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে। সম্প্রতি নদীকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য শহরের বাসিন্দাদের সহযোগিতা চেয়ে প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে। তবে শুধু আন্দোলন করলে হবে না। প্রশাসন কিংবা সরকার যদি এই দাবিগুলো কর্ণপাত না করে, তাহলে কার্যত কোনো লাভ হবে না। আমাদের দাবি, শিগগিরই নদী দখলদারদের চিহ্নিত করে তাঁদের স্থাপনাগুলো সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হোক। নদীটি পুনঃখনন করের এর প্রাণ ফিরেয়ে আনা হোক।’

জানতে চাইলে পাউবোর নওগাঁ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘তুলসীগঙ্গার পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে সদর উপজেলার চককতুব রেগুলেটর থেকে নওগাঁ শহরের তুলসীগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। ঠিকাদারও নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ কিলোমিটার অংশ খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। তুলসীগঙ্গা সেতু থেকে উজান অংশে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য শিগগিরই আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হবে। আশা করি, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নদীটি প্রাণ ফিরে পাবে।’