এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে লবণে কোটি টাকার ক্ষতি

বৃষ্টির পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লবণ মাঠ। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা মাঠের লবণ সরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। গতকাল চৌফলদন্ডি এলাকায়।  প্রথম আলো
বৃষ্টির পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লবণ মাঠ। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা মাঠের লবণ সরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। গতকাল চৌফলদন্ডি এলাকায়। প্রথম আলো

কক্সবাজারে বৃষ্টি ছিল মাত্র এক ঘণ্টা। এর মধ্যেই মাঠের লবণের ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এ ছাড়া মাঠে পানি জমে আগামী কয়েক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ৫০ হাজার একর জমিতে লবণের উৎপাদন।

গতকাল সোমবার সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। সকাল ৯টার পর হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। সঙ্গে বজ্রপাত। সোয়া ১০টা পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিতে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় লবণ মাঠের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে নয়াকাটা, চরধুরুং, আলী আকবরবলীপাড়া, মিজ্জিরপাড়া, বাঁকখালীপাড়ায় বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেড় হাজার একরের লবণ মাঠ।

চরধুরুং গ্রামের চাষি ছাবের আহমদ (৪২) বলেন, বৃষ্টিতে তাঁর ৪০ একর লবণ মাঠ ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির মিষ্টি পানি সরিয়ে মাঠ লবণ উৎপাদন উপযোগী করতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ দিন। গত বছর তিনি প্রতি একরে ৩১২ মণ লবণ উৎপাদন করেছিলেন। উৎপাদন বন্ধ থাকলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।

উত্তর ধুরুং ইউপি চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিশেহারা কয়েক হাজার চাষিদের দুঃখ বাড়িয়ে দিয়েছে এক ঘণ্টার বৃষ্টি। ঝোড়ো হাওয়ায় চাষিদের ২০-৩০টি ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গতকাল দুপুরে উখিয়ার মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে নিদানিয়া ও পাটোয়ারটেক এলাকায় দেখা গেছে, বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ সংস্কার করছেন চাষিরা। নিদানিয়ার চাষি আবুল কালাম (৪৫) বলেন, বৃষ্টিতে তাঁর চার কানি মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হঠাৎ বৃষ্টিতে বিপুল পরিমাণ লবণ গলে গেছে। টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলাতেও বৃষ্টিতে বিপুল পরিমাণ লবণ গলে গেছে।

বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, এই বৃষ্টিতে মাঠে লবণ গলে চাষিদের ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা দাঁড়াবে। কয়েক দিনের মধ্যে সঠিক হিসাব নিরূপণ করা হবে।

বিসিক সূত্র জানায়, এ বছর দেশে লবণের জাতীয় চাহিদা ১৬ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিকটন। জেলার প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ১৮ লাখ মেট্রিকটন। এবার পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে বলে আশা ছিল চাষিদের। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেই আশায় শঙ্কা তৈরি করেছে।

এমনিতে চীন থেকে আনা লবণে বাজার সয়লাব হওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লবণের দাম কমে যাওয়াতে হতাশ ছিলেন চাষিরা। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ চাষিদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

চাষিরা বলেন, গত ১ ডিসেম্বর থেকে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার, উখিয়া উপকূলে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আড়াই মাসে উৎপাদিত হয়েছে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯০৪ মেট্রিকটন লবণ। কিন্তু লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ১২০ থেকে ১৮০ টাকায়, যা গত জানুয়ারি মাসেও বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৮০ টাকায়।

বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, চলতি মৌসুমে (১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) জেলার প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত রোববার পর্যন্ত চাষিরা লবণের বাম্পার উৎপাদন করলেও দামে কমে যাওয়ায় তাঁরা হতাশ ছিলেন। ফ্যাক্টরিতে কেমিক্যালে ব্যবহারের নামে চীন থেকে আমদানি করা লবণে বাজার সয়লাব হওয়ায় স্থানীয় লবণের চাহিদা কমে গেছে বলে চাষিরা অভিযোগ করছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গত রোববার পেকুয়ার মগনামা কাজী মার্কেট এলাকায় বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ, বিদেশি লবণে বাজার সয়লাব এবং উৎপাদিত লবণের নায্যমূ্ল্য নিশ্চিতের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন স্থানীয় কয়েক শ লবণচাষি। একই দাবিতে লবণচাষিরা মহেশখালী, কক্সবাজার সদর ও কুতুবদিয়াতেও মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।

লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, প্রতি মণ লবণের বিপরীতে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ৭০-৮০ টাকা কমিয়ে দিয়েছেন। এখন চাষিদের ১৫০ টাকায় লবণ বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অন্যদিকে কেমিক্যালে ব্যবহারের নামে চীন ও ভারত থেকে লাখ লাখ মেট্রিকটন লবণ এনে বাজায় সয়লাব করা হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। লবণ উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত জেলার পাঁচ লাখ মানুষ এখন পথে বসার উপক্রম দেখা দিয়েছে।