সেই আবজালের শাশুড়ি-শ্যালককে দুদকে তলব

আবজাল হোসেন
আবজাল হোসেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের শাশুড়ি রেহেনা বেগম ও শ্যালক রেজাউল ইসলামকে (বুলবুল) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ বুধবার তাঁদের তলব করে চিঠি পাঠিয়েছেন সংস্থার উপপরিচালক সামছুল আলম।

এই দুজনকে ৭ মার্চ সকালে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে রেজাউলকে আগেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সূত্র জানায়, সম্প্রতি আবজালের শাশুড়ি তাঁর নামে থাকা কিছু সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করেছেন বলে দুদকের কাছে তথ্য আসে। ওই সব সম্পদের উৎস জানা এবং আবজালের সম্পদের বিষয়ে জানতে তাঁকে তলব করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি আবজাল, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম এবং তাঁদের ১৫ জন নিকটাত্মীয়ের আরও সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে সংস্থাটি। সুনির্দিষ্টভাবে এই ১৭ জনের সম্পদের খোঁজ চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় চিঠি দেয় সংস্থাটি।

এর কারণ হিসেবে দুদকের অনুসন্ধান সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, তাঁদের ধারণা আবজালের যেসব সম্পদের তথ্য তাদের হাতে আছে, তার বাইরেও অনেক সম্পদ রয়েছে। আবজাল দম্পতি তাঁদের নিকটাত্মীয়দের নামে ওই সব সম্পদ করেছেন। তাই ওই সব সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়। আবজালের শাশুড়ি তাঁর নামে থাকা একাধিক স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন বলেও তথ্য আসে। তথ্য পেয়েই সেসব সম্পদের কাগজপত্র আইন অনুযায়ী জব্দ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুরোধ করা হয়।

যাঁদের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন আবজাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম, আবজালের ছেলে রুলমান আহমেদ রাকিব, দুই মেয়ে আনিকা সুলতানা রুপা ও আদিবা সুলতানা রথি, শ্বশুর জয়নাল তালুকদার, শাশুড়ি রেহেনা বেগম, তিন শ্যালক রফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম; তিন শ্যালকের স্ত্রী রুমানা, রুমা খান ও লিমা আক্তার; দুই ভাই বেলায়েত হোসেন ও লিয়াকত হোসেন, দুই ভাইয়ের স্ত্রী ঝর্ণা আক্তার ও নাসরিন আক্তার লাকি।

এঁদের মধ্যে আবজালের দুই ভাই ও তিন শ্যালককে এর আগে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এই পাঁচজনও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত। আবজালের দুই ভাই হলেন ফরিদপুর টিবি হাসপাতালে ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন ও জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারে হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন। তিন শ্যালক হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম।

দুদক সূত্র জানায়, ১২ ফেব্রুয়ারি দুদকের পক্ষ থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং এসব জেলা রেজিস্ট্রারকে চিঠি পাঠিয়ে ১৭ জনের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা রাজউক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গিয়ে কথা বলেছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক অর্থাৎ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন আদালত।

আদালতের আদেশের পরপরই বিজি প্রেস থেকে গেজেট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় আদালতের আদেশ পৌঁছে গেছে। আদালতের নির্দেশ অনুসারে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান ও বাংলা দৈনিক অগ্রসর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক বরাবর দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানায় সূত্রটি। চিঠিতে আবজাল, তাঁর স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের সব ব্যাংক হিসাবের বিষয়ে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম আলোয় খবর বেরোয়, আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করার জন্য আদালত আদেশ দিলেও তাঁদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়নি। ব্যাংকের এসব হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনসহ অন্যান্য লেনদেন চলছে। আদালতের আদেশের পর দুই সপ্তাহেই আবজাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম ও অন্যান্য কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত লেনদেন হয়েছে। রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, যার মাধ্যমে সরকারি ঠিকাদারি কাজের বিল আদায় হতো, সেটিও সচল আছে এবং লেনদেন চলছে। আবজালের নিজের নামে ও তাঁর যেসব নিকটাত্মীয়কে দুদক জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় এনেছে, তাঁদের হিসাবও সচল।

ওই সব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জব্দের কোনো আদেশ না থাকায় এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তাঁরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো আদেশ নেই।

তখন দুদক বলেছে, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট যেসব ব্যাংক হিসাবের তথ্য ছিল, সেগুলোর তথ্য উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদকের কাছে থাকা তথ্যের বাইরে কোনো ব্যাংক হিসাব থাকলে সেখান থেকে হয়তো টাকা তুলতে পারে। কিন্তু আদালতের নির্দেশের পর কোনো ব্যাংক ওই দম্পতির টাকা ছাড় করলে সে বিষয়ে দুদক ব্যবস্থা নেবে।

ওই প্রতিবেদনের পর দুদক আরও তৎপর হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে আবজাল দম্পতি ও তাঁদের সংশ্লিষ্ট আত্মীয়স্বজনের সম্পদ ফ্রিজ করতে ব্যবস্থা নেওয়া জন্য আবারও অনুরোধ জানানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন তথ্যের জন্য দুদক এসব দপ্তরে নতুন করে চিঠি পাঠিয়েছে।

আবজাল হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক স্টেনোগ্রাফার। এখন তিনি রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা করেন।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়েন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তাঁর ও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনা খানমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হলেও তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে আবজাল ও রুবিনার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তাঁর। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন তিনি। ২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান পদে যোগ দেন। সম্প্রতি সাতক্ষীরায় বদলি করা হলেও দুই মাসের মধ্যেই ঢাকা ফিরে আসেন আবজাল।

আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম একই প্রকল্পে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তাঁরা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

অফিস সহকারী বা কেরানি হিসেবে চাকরি নিলেও আবজাল হোসেন অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, বিএনপি আমলে নিয়োগ পেলেও সব আমলেই সমানভাবে প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, কাজ না করে বিল তুলে নেওয়ার মতো কাজগুলো করেছেন আবজাল। এর মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ।