বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালাতেও 'শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ' স্পষ্ট নয়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালাতেও অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের ক্ষেত্রে ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ’ কোনটি হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে আদালত বিয়ের আবেদন বাতিল করে দেবেন, তা বলা আছে বিধিতে। গত বছরের অক্টোবর মাসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে। নারী অধিকার এবং মাঠপর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থার প্রতিনিধিরা বলছেন, আইনের বিশেষ ধারা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। তখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি বিধিতে স্পষ্ট করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। ফলে জটিলতা থেকেই গেল।

২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান (১৯ ধারায়) বলা আছে, নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং বাবা-মা অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। তবে এই আইনের বিশেষ ধারা ছাড়া ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেরা বিয়ে করলে তা বাল্যবিবাহ হবে।

আইনটির বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘আইনের বিশেষ বিধানের আলোকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উপযুক্ত আদালতে উভয় পক্ষের পিতামাতা/আইনগত অভিভাবক বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্কসহ উভয় পক্ষ অথবা বিয়ের পাত্রপাত্রী উভয়ে যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে কারণ উল্লেখপূর্বক দালিলিক প্রমাণসহ (যদি থাকে) আবেদন করতে পারবে। আদালত আবেদনটির সত্যতা যাচাইয়ে যাচাই কমিটিতে পাঠাবেন।’

আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে থেকেই আইনের বিশেষ বিধান নিয়ে নারী ও মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। আইন চূড়ান্ত হওয়ার পর বিধিতে যাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কারা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবক কে হবেন, কোন কোন কারণে আদালত বিয়ের অনুমোদন দেবেন, তা স্পষ্ট করার দাবি তোলা হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় এবং আইন কমিশনের কাছে সুপারিশও পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমাদের দেখতে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বিশেষ বিধানের যাতে অপব্যবহার না হয়, তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, যা আমরা করছি।’

আয়শা খানম বলেন, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ কোনটি, তা স্পষ্ট করা হয়নি। স্পষ্ট হওয়ার কথাও না। কেননা এই আইন ও বিধিমালা সরকারের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। যেসব সংগঠন কয়েক দশক ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে, সেসব সংগঠনের অভিজ্ঞতাকে সম্মান করা হয়নি। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও গণতান্ত্রিক ছিল না। পুরো প্রক্রিয়াই অংশীদারত্বমূলক হয়নি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিধির যে প্রাথমিক খসড়া করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল, প্রেমের সম্পর্কের কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেরা বিয়ে করলে এবং মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে বা সন্তানের মা হয়ে গেলে আদালত বিয়ের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবেন। আবার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটির ভরণপোষণের উপযুক্ত নিকটাত্মীয় কেউ না থাকলে, সে ক্ষেত্রেও আদালত তাঁর বিশেষ এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবেন।

সে সময় মেয়েশিশুর ভরণপোষণের কেউ না থাকলে তাকে বিয়ে দেওয়াসহ সরকারের পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয় উল্লেখ করে নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা চূড়ান্ত করার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু) মাসুক মিয়াকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনকেও রাখা হয়েছিল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিধিমালা প্রণয়নের ড্রাফটিং কমিটিতে ছিল। আসকের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নীনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, কমিটিতে রাখা হলেও আসকের কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হচ্ছে না দেখে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি থেকে বের হয় যায় আসক। কেননা বিধিমালা যেভাবে হচ্ছে, বিশেষ করে বিশেষ বিধানের দায় আসক কোনোভাবেই নিতে চায়নি।

নীনা গোস্বামী বলেন, আসকের পক্ষ থেকে বিশেষ বিধানের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ১৬ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তা–ও মানা হয়নি। এতে নয় বছরের শিশুর জন্যও বিয়ের জন্যও সর্বোত্তম স্বার্থের কথা বলে অভিভাবক আদালতে আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া এই কমিটিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) মতো সংগঠনের প্রতিনিধিদের কেন রাখা হয়নি, তা–ও লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল আসক।

বিধিমালা প্রণয়ন কমিটিতে থাকা আমরাই পারি জোটের নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ স্পষ্ট করা হয়নি, তবে বিশেষ বিধানে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে কঠিন করা হয়েছে। তবে জিনাত আরা হক বলেন, আইনের এ বিশেষ বিধান বাতিলের দাবি তোলা হচ্ছে শুরু থেকে, সে দাবি অব্যাহত আছে। আইনে সংশোধনের সুযোগ আছে।

বিধিতে বিশেষ বিধানের ক্ষেত্রে যা বলা আছে

যাচাই কমিটি বিয়ের আবেদনের বিষয়টি যাচাইয়ের পর অনধিক ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কমিটির সভাপতি করে প্রতি উপজেলায় অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ যাচাই কমিটি গঠন করা হবে। এতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার মনোনীত একজন মেডিকেল অফিসার, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মনোনীত একজন কিশোর ও একজন কিশোরী এবং উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা (কমিটির সদস্যসচিব) এ কমিটিতে দায়িত্ব পালন করবেন। যাচাই কমিটি অনুসন্ধান করে বিবাহটি অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে হচ্ছে—নিশ্চিত হলে নির্ধারিত বয়সসীমার আগে আবেদিত বিয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামতসহ উপযুক্ত আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে। তবে শর্ত হিসেবে আবেদন করা বিয়েটি জোর করে সংঘটিত হলে, বিয়েটি ধর্ষণ, অপহরণ, জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি কারণে সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোনো মামলা বিচারাধীন থাকলে যাচাই কমিটি নির্ধারিত বিয়ের আগে বিয়ে না দেওয়ার জন্য মতামত জানিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেবে।

কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আদালতের কাছে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থেই বিশেষ বিধানের আওতায় বিয়ে হওয়া সমীচীন মনে করলে অনুমতি দেবেন বা প্রয়োজন মনে করলে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত/পুনঃ তদন্তক্রমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারবেন। যাচাই কমিটি লিখিত প্রতিবেদন সিলমোহর করা খামে আদালতে পাঠাবেন। আদালত প্রয়োজন বিবেচনা করলে কমিটিকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আদেশ দিতে পারবেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ নির্ধারণের বিষয়টি আদালতের বিবেচনার ওপরই রাখা হয়েছে। আদালত শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ মনে করলেই অনুমতি দেবেন। আর এই আবেদন করাসহ পুরো প্রক্রিয়াটিকে কঠোর করার কারণে এ বিধানের আওতায় সহজে কেউ আবেদনও করবেন না। বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে এখন পর্যন্ত আইনের এ বিশেষ বিধানের অপপ্রয়োগ হয়েছে বলেও শোনা যায়নি।