এক ভাষাসৈনিকের আক্ষেপ

ভাষাসৈনিক আবদুল মোতালেব দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর এলাকার নিজ বাসভবনে।  ছবি: প্রথম আলো
ভাষাসৈনিক আবদুল মোতালেব দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর এলাকার নিজ বাসভবনে। ছবি: প্রথম আলো

ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে যুক্ত ছিলেন ছাত্ররাজনীতিতে। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকতসহ বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ায় আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের ওই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দিনাজপুরেও ওই সময় দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এ জন্য বেশ কয়েকবার জেলে পর্যন্ত যেতে হয় তাঁকে। দিনাজপুরের এই ভাষাসৈনিকের নাম আবদুল মোতালেব।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবদুল মোতালেব বললেন, ‘ভাষার জন্য জেল খেটেছি, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তাতে কোনো কষ্ট নেই। তবে আমার কষ্ট হয় সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়ায়। সঙ্গে আছে ভাষাসৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ।’ আবদুল মোতালেবের মতে, শুধু মুখের কথাটাই বাংলা ভাষায় বলা হচ্ছে। তাতেও আছে নানা ধরনের বিকৃতি। উচ্চ আদালতে এখনো পুরোপুরি বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু হয়নি। তিনি বলেন, যাঁরা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের তালিকা করা হয়েছে। কবরে নেওয়ার আগে সর্বশেষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দেওয়া হয়। একইভাবে সারা দেশের ভাষাসৈনিকদের তালিকা তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সম্মানীর প্রয়োজন নেই। ভাষাসৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হতে চাই।’

গত বুধবার দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর এলাকায় নিজ বাসভবনে চেম্বারে বসে তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘তখন আমি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজ) উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কলেজ ক্যাম্পাসে হঠাৎ বিবিসি রেডিওতে সংবাদ শুনলাম, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। সংবাদ শোনার পর আর দেরি করিনি। সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র ইউনিয়নের সহযোদ্ধা আছেল উদ্দিন, আবদুল হাফিজ, নুরুল হুদা কাদের বখস, রহিমউদ্দিন আহমেদসহ প্রায় ৩০ জনকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করি। প্রথমে দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজারে এসে নুরুল আমিন মার্কেট এবং পরে খাজা নাজিমুদ্দিন হলসহ উর্দু ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড ভাঙচুর করি।’

এরপর আস্তে আস্তে দিনাজপুরের সব জায়গায় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামগঞ্জে কৃষক, মজুর, শ্রমিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁদের নেতৃত্বে দিনাজপুরে বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়।

১৯৩২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে জন্ম আবদুল মোতালেবের। বাবা নাছির উদ্দীন ও মা সালেহা খাতুনের ছয় সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। পেশায় আইনজীবী হলেও বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। ৮৭ বছর বয়সে এসে এখন ভুগছেন ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে। স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগম (৭৮) অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। এক ছেলে ২০০০ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মেয়ে তাঁর স্বামীসহ বাস করেন আমেরিকায়। এখন তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী। ২০০৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে তাঁকে ভাষাসৈনিক হিসেবে সম্মাননা জানায় দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতি।

ভাষা আন্দোলনের কারণে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবদুল মোতালেব বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন তাঁর সঙ্গে আবদুল হাফিজ ও আছেল উদ্দিনও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জেল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু অনুমতি পাননি তিনি। ৬ মাস জেলে থেকে কারামুক্ত হন। এরপর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিনাজপুরের আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। পরের বছর আবারও পরীক্ষার আগে গ্রেপ্তার হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হয়নি। অবশেষে ১৯৫৪ সালে এইচএসসি ও ১৯৫৬ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৫৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন তিনি। এরপর দিনাজপুর আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

আবদুল মোতালেব বলেন, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু ভাষাসৈনিকদের কেউ কোনো খোঁজ রাখে না।