আনন্দের অনন্য ভুবন এক স্কুল

ছুটির ঘণ্টা বাজতেই শিক্ষার্থীরা খেলায় নেমে পড়ে। গত বুধবার বিকেলে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়।  ছবি: প্রথম আলো
ছুটির ঘণ্টা বাজতেই শিক্ষার্থীরা খেলায় নেমে পড়ে। গত বুধবার বিকেলে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবি: প্রথম আলো

বিকেল চারটায় ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বেরিয়ে এল শিক্ষার্থীরা। কেউ ফুটবল নিয়ে, কেউ দৌড়ঝাঁপে মেতে উঠল। কেউ কেউ আবার স্কুলের পুকুরে নৌকা চালাতে ছুটে গেল। একটা দলকে শহীদ মিনারের বেদিতে বসে গানের চর্চা করতে দেখা গেল। ভাগ হয়ে এসব কিছুর তদারকি করছিলেন শিক্ষকেরা। বিকেল পাঁচটার আগে স্কুল ছেড়ে চলে গেল সবাই। কিন্তু ২৪-২৫ জনের একদল শিক্ষার্থী আবার ফিরে গেল শ্রেণিকক্ষে। বসল বই নিয়ে।

শিক্ষক নারগিস আক্তার বলেন, ‘আমরা সোলারের (সৌরবিদ্যুৎ) আলোতে পিছিয়ে পড়াদের রাত ৯টা পর্যন্ত অতিরিক্ত পাঠদান করি। পঞ্চম শ্রেণির আগ্রহী ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির মেধাবী ও গরিব ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়।’

এ চিত্র ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। শুধু খেলাধুলা আর দুর্বল ছাত্রদের জন্য অতিরিক্ত যত্ন নয়, বিদ্যালয়জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এক মুগ্ধকর পরিবেশ। শিশুদের জন্য খেলার মাঠের এক পাশে আছে দোলনা, গরুর গাড়ি। পুকুরে নৌকা। পুকুরের দক্ষিণ ও পূর্ব দেয়ালে আঁকা রয়েছে বাঘ, ভালুক, ময়ূর, চিত্রা হরিণ, খরগোশ, হাতি, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। আর মাটিতে ফুলের গাছ দিয়ে বানানো হয়েছে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি এবং পড়াশোনায় উৎসাহী করতে ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকের প্রচেষ্টা ও পরিচালনা কমিটির সহায়তায় ‘মিড ডে মিল’ (দুপুরের খাবার) চালু করে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে স্কুলটি। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বয় সভায় এই স্কুলের ‘মিড ডে মিল’–এর মডেলটি আলোচনায় আসে। এরপর অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে এই স্কুলকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি বর্তমানে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে নেওয়া হয়েছে সমাজসেবামূলক নানা উদ্যোগ।

২০ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা গেল, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ ও টিনশেড ঘরের দুই কক্ষের মেঝের এক পাশে কয়েকটি করে কম্বল, মাদুর ও বালিশ রাখা। দিনের বেলা ক্লাস করার পর রাতে সেখানেই থাকে ১৯ শিক্ষার্থী। সবাই মেধাবী কিন্তু ঝরে পড়ার উপক্রম। খণ্ডকালীন শিক্ষক মো. হানিফ জানালেন, তাদের থাকা-খাওয়া ও সৌরবিদ্যুতের আলোয় পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক এরফান আলী।

শুরুর কথা
বকুয়া ইউনিয়নের বহরমপুর বাজারের নুরুল ইসলামের মুদি দোকানের সঙ্গেই তাঁর ছেলে এরফান আলী ২০০০ সালে চা-পরোটার দোকান চালাতেন। পাশেই ব্রক্ষ্মপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই-তিনবার চা নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতেন এরফান। এইচএসসি পাস করা এরফানও স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হওয়ার। ছেলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে স্কুল খোলার জন্য ২০০১ সালে ৩৩ শতাংশ জমি দেন নুরুল ইসলাম। শুরু হয় এরফানের লড়াই। চরভিটা গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ ধানখেতের সেই জমি সাফ করে সেখানে খড়-বাঁশের তিনটি ঘর তৈরি করে চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিলেন। ২০০৮ সালে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন তিনি। ২০১১ সালে বিদ্যালয়টি পাঠদানের অনুমতি পাওয়ায় উদ্দীপনা দেখা দেয় এরফান ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে। শিক্ষার্থীর সন্ধানে রাতদিন অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান তাঁরা। এতে সফলতাও আসে। বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। গড় উপস্থিতি ছিল ৬৫-৭৫ জন। ২০১৪ সালে ‘মিড ডে মিল’ চালু করার পর শিক্ষার্থীর গড় উপস্থিতি ৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়।

২০১৩ সালে সরকারি হওয়ার সাড়ে চার বছর পর প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন সহকারী শিক্ষক সাড়ে চার বছরের বকেয়া বেতনের ৩২ লাখ টাকা একসঙ্গে পান। এর মধ্যে ১৮ লাখ টাকা খরচ করা হয় পুকুরের সীমানাপ্রাচীর ও পুকুরের জন্য ১০ শতক জমি কেনা বাবদ। বর্তমানে ৪৪ শতক জমির ওপর বিদ্যালয়, শহীদ মিনার এবং ৬৬ শতকের ওপর পুকুর ও ছবির মিউজিয়াম মিলে ১ একর ১০ শতক জমি রয়েছে বিদ্যালয়ের। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২০।

২০১১ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) শতভাগ ছাত্রছাত্রী পাস করছে। ২০১৮ সালের ৪০ জনের সবাই পাস করেছে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ২০১৫ সালে ছেলে ফুটবল দল এবং ২০১৭ সালে মেয়ে দল হরিপুর উপজেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা পর্যায়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলে। শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকায় তিনজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে।

মিড ডে মিল
বিদ্যালয়ের পাশের খালি জায়গায় করা বাগানের পেঁপে ও পুকুরে পালন করা হাঁসের ডিম দিয়ে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। স্কুলের সভাপতি নুরুল ইসলাম তাঁর মুদি দোকান থেকে লবণ ও তেল দেন। সহসভাপতি কলিমউদ্দীন আহাম্মদ, সদস্য আমিরউদ্দীন ও জসিম উদ্দীনসহ চরভিটা, বহরমপুর, তাঁতিহাট এলাকার কয়েকজন বিত্তবান নিয়মিত সহায়তা করছেন। প্রধান শিক্ষক দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সালে তাঁতিহাট গ্রামে ১০ বিঘা জমিতে আমবাগানও করেছেন। বিভিন্ন গ্রামের দুস্থ লোকজনের মধ্যে কম্বল বিতরণ, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, গাছ রোপণ, রাস্তা সংস্কারসহ আরও বিভিন্ন কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন প্রধান শিক্ষক।

হরিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম জে আরিফ বেগ বলেন, চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল মিড ডে মিল, পাঠোন্নয়ন ও বিদ্যালয়–বহির্ভূত আর্তমানবতা, সমাজ ও জনসেবামূলক পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি সময় পেলেই ওই বিদ্যালয়ে ছুটে যান।

এরফান আলী বলেন, ‘মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী। আমি চরভিটা বিদ্যালয়কে আরও আলাদা মডেলে প্রতিষ্ঠিত করে চরভিটা গ্রামকে আদর্শ গ্রামে রূপান্তরিত করতে চাই।’