সার্বিক প্রস্তুতি দরকার

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তৃতা করছেন মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। পাশে নাসিমা সুলতানা। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তৃতা করছেন মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। পাশে নাসিমা সুলতানা। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের হাসপাতালগুলোতে দুই রকমের প্রস্তুতি দরকার। এক. দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষকে তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়া এবং হাসপাতাল নিজে ঝুঁকিতে না থেকে সার্বিক প্রস্তুত থাকা। দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষতা অর্জনে হাসপাতালগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ করা উচিত। সেই বাজেট যথাযথ কাজে লাগছে কি না, তা তদারক করাও জরুরি।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন আলোচকেরা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ বাড়ছে। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি চকবাজারের অগ্নিদুর্ঘটনার মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগও হচ্ছে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় কৌশলগত পরিবর্তন দরকার। শুধু এটা করতে হবে, ওটা করা দরকার বললে হবে না। বাস্তবে কাজ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশ অনেকটা এগিয়েছে। তবে আরও ব্যবস্থা না নিলে হাসপাতাল নিজেই দুর্যোগে পরিণত হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা না হলে দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘জাতিগতভাবে আমরা নিয়ম না মানার একটি সংস্কৃতি লালন করি। আবার সরকারি পর্যায় থেকেও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকে। আবার স্বাস্থ্য খাতে বাজেট খুবই ছোট। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ যুক্ত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে এমনিতে রোগী ভর্তি বেশি থাকে। তাই নতুন ঝুঁকি আছে।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান বলেন, উন্নয়নের ধারায় দেশে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ফায়ার কোড ও বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন বানানোর প্রবণতা আছে। বাসাবাড়িতে গোডাউন, দোকান ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল খুবই স্পর্শকাতর জায়গা। প্রতিটি হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি কর্তৃপক্ষ অথবা টাস্কফোর্স গঠন করার পরামর্শ দেন তিনি।

 সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া বলেন, ‘হাসপাতালের বাইরে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত নই। কারণ, এককভাবে বড় দুর্ঘটনা সামাল দেওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের হাসপাতালগুলোর নেই। চকবাজারে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল, এর জন্য কি শুধু সরকার দায়ী। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা সচেতন হব, জেগে না উঠব, নিরাপত্তা সংস্কৃতি না মানব, ততক্ষণ আগুনের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটবেই।’

 ইউএনডিপির ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বিশেষজ্ঞ সাউদিয়া আনোয়ার বলেন, অনেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে অনেক হাসপাতাল। জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা মেনে হাসপাতালগুলো তৈরি করতে হবে। এই ব্যবস্থার জন্য শুধু নেতৃত্ব ও সদিচ্ছা প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, দেশি–বিদেশি সংস্থার সমন্বিতভাবে কাজ করার সুযোগ আছে।

ফায়ার অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল সেফটি বাংলাদেশের সভাপতি মোতাহার হোসেন বলেন, হাসপাতালে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে জরুরি ভিত্তিতে নিরাপদে রোগীদের সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। জরুরি সময়ে সংকটাপন্ন রোগীদের দ্রুত বের করে আনতে হাসপাতালগুলোর আইসিইউ এবং সিসিইউ ভবনের নিচতলার দিকে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরামর্শক রেজাউল করিম বলেন, টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। হাসপাতালগুলোতে আকস্মিক ঘটনা ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এর জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। এটা সরকারকেই বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে।

পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, যাঁরা হাসপাতালে আসেন, একধরনের দুর্যোগে পড়ে তাঁরা আসেন। এখানে এসে যদি আবার আরেক দুর্যোগে পড়েন, সেটা মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি কি আছে? তবে আশার কথা, সরকার থেকে বিভিন্ন সংস্থা এসব নিয়ে কাজ করছে।

নিয়মিত মহড়া করার ওপর জোর দেন জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) অধ্যাপকমন্‌জুরুলহক। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছুটা হলেও জায়গা থাকে। তবে জায়গা কম থাকার কারণে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বেশি ঝুঁকিতে আছে। বছরে অন্তত একবার হাসপাতালগুলোতে দুর্যোগ মহড়া পরিচালনা করা উচিত।

সেভ দ্য চিলড্রেনের হিউম্যানিটেরিয়ান ডিরেক্টর মো. মোশতাক হুসাইন বলেন, কোথায় যেন সমন্বয়ের একটা ফাঁক আছে। আন্তমন্ত্রণালয়ের যদি সমন্বয় থাকত, তাহলে হাসপাতালগুলোর অগ্নিনির্বাপণে বাজেট বরাদ্দের নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থা হতো।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিআরএম অ্যান্ড সিসি বিভাগের প্রধান ইমামুল আজম শাহী বলেন, দুর্যোগ–পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ–পরবর্তী—এই তিন ধাপ নিয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য যা যা সম্পদ ও লোকবল প্রয়োজন, তা যুক্ত করতে হবে।