সংবাদপত্র কাড়াকাড়ি করে পড়ে ওরা

বিদ্যালয়ের সংবাদপত্র কর্নারে পত্রিকা পড়ায় ব্যস্ত শিশুশিক্ষার্থীরা।  ছবি: প্রথম আলো
বিদ্যালয়ের সংবাদপত্র কর্নারে পত্রিকা পড়ায় ব্যস্ত শিশুশিক্ষার্থীরা। ছবি: প্রথম আলো

প্রতিদিন দৈনিক সংবাদপত্র, কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তা পড়তে না পারলে এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার শংকরবাটি-পোল্লাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভালো লাগে না। তাই বিদ্যালয়ে এসে কে আগে দৈনিক পত্রিকাটি হাতে নেবে, তা নিয়ে শিশুশিক্ষার্থীদের মধ্যে মধুর ঝগড়া-ঝাঁটিও হচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে দারুণ খুশি তারা।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে জানা যায়, ৫৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এই শ্রেণিতে। কিন্তু কারও বাড়িতেই সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ নেই। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অসচ্ছল পরিবারের। দেড় মাস ধরে তারা সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ জন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগে বিদ্যালয়ে আসছে তারা। এ ছাড়া টিফিনের সময়ও পড়ছে। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন পড়ে সারা দেশের মানুষের কথা, সারা পৃথিবীর কথা জানতে পারছে।
পঞ্চম শ্রেণির পরাগ মাহমুদ জানায়, কুষ্টিয়ায় ইউনানি সিরাপ খেয়ে দুজনের মৃত্যুর ঘটনা, মেয়ের বেতন দিতে না পেরে বাবার আত্মহত্যার মতো খবর পড়ে তার মন খুব খারাপ হয়েছিল। আবার দুই হাত না থাকা এক মেয়ে পা দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার খবরটি পড়ে সে ও তার সঙ্গীরা সবাই অনুপ্রাণিত বোধ করেছে।

কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তা পড়ে সাফিয়া, আসিফা, সানজিদা, মনিকা, সালমা, আরেফিন, তাহের, ওসমানসহ অন্যরা জানতে পেরেছে, কীভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হয়, আবহাওয়া কীভাবে বোঝা যায়, কীভাবে চাঁদে যাওয়া যায়, বিভিন্ন ধরনের প্রজাপতি, পানির জাদু, প্লাস্টিকের সমুদ্র আরও কত–কী।
কিশোর আলোর আষাঢ়ে গল্প পড়ে মজা পেয়েছে অনেকেই। আর পত্রিকায় প্রকাশিত পোপ ফ্রান্সিস মিসরের আল আজাহারের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শেখ আহমেদ আল তাথারকে সৌহার্দ্য চুম্বন দেওয়ার ছবি দেখতে গিয়ে টানাটানিতে পত্রিকা ছিঁড়ে গিয়ে ঝগড়া বেধে যায় মনিকা ও সালমানের মধ্যে।

অন্যদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা মনিকা আর সালমানকে মৃদু বকা দিলেও আড়ালে গিয়ে মুচকি হেসেছেন। পরে টেপ দিয়ে ছেঁড়া পত্রিকা জোড়া লাগিয়ে পড়ার উপযোগী করে দিয়ে দুই শিশুর মধ্যে আবার ভাব করিয়ে দেন বলে জানান মনোয়ারা খাতুন। এই প্রধান শিক্ষক আরও জানান, বিদ্যালয়টি দুই শিফটে চলে। দ্বিতীয় শিফট শুরু হয় দুপুর ১২টায়। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এ শিফটে পড়ে। আগে অন্য শ্রেণির পাঠদানে বিঘ্ন ঘটবে বলে ১২টার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হতো না। কিন্ত এখন সংবাদপত্র পড়ার নেশায় অনেকে আগে আসে। তাদের শর্ত দেওয়া ছিল, নিঃশব্দ পায়ে ভবনে দোতলায় উঠে কর্নারে গিয়ে সংবাদপত্র পড়বে। এ শর্ত তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে শুধু পড়ার নেশায়। দৈনিক কেমন করে পড়তে হয়, কেমন করে এক পৃষ্ঠার সংবাদের বাকি অংশ পড়তে অন্য পৃষ্ঠা ও কলামে যেতে হয়—প্রথমে এসব জানা ছিল না এ শিশুদের। এখন সব শিখে গেছে। তাদের আগ্রহ দেখে শিক্ষকেরাও খুব খুশি। তিনি বলেন, ‘আমরা সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়াতে চাই। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শহীদুল হুদা একটি দৈনিক, চাঁপাইনবাবঞ্জের প্রথম আলো বন্ধুসভার পক্ষ থেকে কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তা দেওয়া হচ্ছে। আরও কিছুর জন্য আমরা দাতা খুঁজছি।’

এ বিদ্যালয়ের সংবাদপত্র কর্নার সম্পর্কে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আনওয়ার হোসেন (উন্নয়ন ও আইসিটি) বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল কাদের, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজমা খাতুন, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মহা. তাশেম উদ্দিন ও আমি। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার বিদ্যালয়ের সংবাদপত্র কর্নারের বিষয়টি পছন্দ করেছেন। সঙ্গের অন্যান্য কর্মকর্তারাও।’

সংবাদ কর্নার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য এটা একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে। সংবাদপত্র পড়তে গিয়ে প্রতিদিন দু–একটি করে হলেও নতুন শব্দ শিখবে ওরা। শিশুদের নতুন নতুন বিষয় জানার আগ্রহ জন্মাবে। এটা একটা বড় ব্যাপার। এ ছাড়া ওই বিদ্যালয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর মায়েদের পাঠদান কার্যক্রম চলছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। উদ্যোগটি ইতিমধ্যে সাফল্য পেয়েছে। শিক্ষদের এসব উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও সহযোগী অন্যান্য কার্যক্রমের উন্নয়নে আমরা সহায়তা দিচ্ছি এবং আরও দিতে চাই। চাই এসব উদ্যোগ যেন অন্যান্য বিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে।’