১১ বছরের স্কুলজীবনের সাড়ে ৪ বছরই নষ্ট

>
  • বাংলাদেশে মানোন্নয়নের কর্মসূচি দুর্বল
  • পাঠদান নিম্নমানের, স্কুল ব্যবস্থাপনা খারাপ সরকারি বিনিয়োগ কম
  • পঞ্চম শ্রেণির প্রতি চারজন শিক্ষার্থীর তিনজনই সাধারণ মানের অঙ্ক কষতে পারে না
  • ৪৩% বাংলায় কোনো প্রশ্নের পুরো উত্তরও দিতে পারে না।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

শিক্ষার দুর্বল মানের কারণে বাংলাদেশের একজন শিশুর ১১ বছরের স্কুলজীবনের সাড়ে ৪ বছর নষ্ট হয়ে যায়। তারা ১১ বছরে শিখে মাত্র সাড়ে ৬ বছরের পাঠ্যক্রমের সমান। আবার দেশের পঞ্চম শ্রেণির প্রতি চারজন শিক্ষার্থীর তিনজনই নিজেদের শ্রেণির উপযোগী সাধারণ মানের অঙ্ক কষতে পারে না।

এ দেশের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে বাংলা পড়ার দক্ষতা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্কোর খুবই কম। এর মানে, তারা ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারে না। তাদের ৪৩ শতাংশ বাংলায় কোনো প্রশ্নের পুরো উত্তরও দিতে পারে না।

বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট: লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার পেছনে চারটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সেগুলো হলো শৈশব জীবনের মানোন্নয়নে কর্মসূচিগুলোর দুর্বলতা, নিম্নমানের পাঠদান, দুর্বল স্কুল ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কম। দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

গতকাল বুধবার স্থানীয় হোটেলে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হাসে রজার্স ও বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল প্র্যাকটিসের ব্যবস্থাপক ক্রিশ্চিয়ান আদো। বিশ্বব্যাংকের মূল প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হলেও গতকাল বাংলাদেশ অংশের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা প্রায় সবাই বলেছেন, মানসম্পন্ন শিক্ষায় বিনিয়োগ করে ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সফল হলেও শিক্ষার মান এখনো উদ্বেগের বিষয়। অন্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মতো বাংলাদেশের অনেক তরুণ নিজেদের পছন্দমতো কাজ পায় না। কারণ তারা যে শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেদের গড়ে তুলেছে, তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পড়া, লেখা ও অঙ্কে দক্ষ করে তুলতে পারছে না। তাই বাংলাদেশকে শিক্ষা খাতে কার্যকরভাবে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রশংসাও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কুলে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে পেরেছে, এমন কয়েকটি দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের হিসাবে প্রায় ৬৪ লাখ মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে। অন্যদিকে ১৯৯০ সালে যেখানে মাত্র ৬৬ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় নিবন্ধিত ছিল, ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৯১ শতাংশ হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়িয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেক বেশি পরীক্ষানির্ভর। শ্রেণিকক্ষে কী শিখল, সেটার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। তবে শিক্ষার্থীরা কী শিখল, সেটার মূল্যায়ন দরকার আছে, তা যেন পরীক্ষানির্ভর না হয়। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি যুগোপযোগী করতে হবে। তৃতীয়ত, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সর্বশেষ শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সেই বিনিয়োগ যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা তদারক করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা উচিত।

মানসম্পন্ন শিক্ষা শুধু বাংলাদেশেই সমস্যা নয়, অন্য উন্নয়নশীল দেশেও একই অবস্থা—এমন চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবের কিছু উদাহরণও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। যেমন কেনিয়া, তানজানিয়া ও উগান্ডার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘দ্য নেম অব দ্য ডগ ইজ পাপ্পি’—বাক্যটি বুঝতে পারে না। ভারতের গ্রামের তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘৪৬’ থেকে ‘১৭’ বিয়োগ দেওয়ার অঙ্ক কষতে পারে না।

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে উন্নয়নশীল দেশ সফল হতে পারে, এমন উদাহরণও আছে ওই প্রতিবেদনে। যেমন ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত, বিজ্ঞান ও পড়ার দক্ষতা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে ভিয়েতনাম ও জার্মানির শিক্ষার্থীরা একই স্কোর করেছে। অথচ জার্মানির চেয়ে ভিয়েতনাম অনেক গরিব দেশ।

অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত আট বছরে শিক্ষা খাতের বাজেট পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন বাজেটের ১২ থেকে ১৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে খরচ হয়। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) মানসম্পন্ন শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল প্র্যাকটিসের জ্যেষ্ঠ পরিচালক হেইমে সাভেদ্র বলেন, শিক্ষার মান বৃদ্ধি যেমন জরুরি, তেমনি পাঠদানের পদ্ধতির উন্নয়নও জরুরি।

শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা ডেনমার্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেগো ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা বুচি বলেন, মানসম্পন্ন শিক্ষা দিয়েই দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সউম।

প্রথম আলো-বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে রচনা প্রতিযোগিতা

প্রথম আলো-বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। গতকালের অনুষ্ঠানে এই উদ্যোগের কথা জানানো হয়। শিগগির আগ্রহীদের কাছ থেকে রচনা আহ্বান করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। প্রতিযোগিতার শিরোনাম—তোমার স্বপ্নের স্কুল। ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নিতে পারবে।