করতোয়া নদীর ৩০ দখলদারের তালিকা ওয়েবসাইটে, নেই পুরোনোদের নাম

নদী কমিশন থেকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বগুড়ার করতোয়া নদী দখলদারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি বগুড়া জেলা প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইটে ৩০ দখলদারের একটি আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

নোটিশ বোর্ড কিংবা শহরের জনবহুল স্থানে নদী দখলদারের তালিকা না টানিয়ে ওয়েবসাইটে আংশিক তালিকা প্রকাশ করায় এটাকে জেলা প্রশাসনের দায় এড়ানোর কৌশল বলছেন স্থানীয় লোকজন।

এ বিষয়ে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী কমিশন থেকে দখলদারের তালিকা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে, সেটা যেকোনোভাবে করলেই হলো। জনবহুল স্থানে কিংবা নোটিশ বোর্ডে তালিকা টানাতে হবে, এমনটা নদী কমিশনের নির্দেশনায় উল্লেখ নেই। এ কারণে জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইটে অবৈধ দখলদারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।’

বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলীমূন রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় তথ্য বাতায়নে’ নোটিশ অপশনে গিয়ে ৫ নম্বর ক্রমিকে করতোয়া নদীর ৩০ দখলদারের নামের তালিকা সংগ্রহ করা যাবে। তালিকায় থাকা দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করে সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়ে নিজ থেকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসন থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এরপর উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া আরও দখলদার চিহ্নিত করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে।’

জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইটে ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা তালিকায় ৩০ দখলদারের মধ্যে রয়েছে- বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস), বগুড়া পৌরসভা শহরের মালতিনগর এলাকার মোহাম্মদ বাদশা, একই এলাকার মোছা. হাজেরা বেওয়া, বাহালুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, লাল মিয়া, বুলু মিয়া, জাকির হোসেন, খলিলুর রহমান, মাটিডালি এলাকার আরিফ হোসেন, নাটাইপাড়ার সাইদুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন, মশিউর রহমান, লুৎফর রহমান, আরিফা বেগম, আবুল কাশেম, বজলুর রশিদ, বজলার রহমান, মো. মিল্টন, গৌর দাস, অনিল কর্মকার, গোপাল চন্দ্র দাস, রাধা চন্দ্র দাস, প্রহ্লাদ, বগুড়া ডায়াবেটিকস হাসপাতাল, গোপীনাথ মন্দির এবং সাহেব বাজার বায়তুল হামদ জামে মসজিদ। দখলদারের তালিকায় একাধিক স্থানে নাম রয়েছে টিএমএসএস এবং বগুড়া পৌরসভার। টিএমএসএস করতোয়া নদীর ৪ দশমিক ৯০ একর জায়গা দখল করে ক্যানটিন, ছাত্রাবাস, নার্সারি এবং পুকুর নির্মাণ করেছে বলেও জেলা প্রশাসনের প্রকাশ করা তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের এই অসম্পূর্ণ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), করতোয়া নদী বাঁচাও নেটওয়ার্কসহ বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাপার জেলা কমিটির সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, করতোয়া নদীর শুধু বগুড়া শহরের অংশেই অবৈধ দখলদার কয়েক শ। দীর্ঘদিন ধরেই সিএস নকশা অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। অথচ আদালত এবং নদী কমিশনের নির্দেশ শর্তেও জেলা প্রশাসন আগে থেকে তাদের কাছে থাকা একটি দায়সারা তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এই অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে প্রশাসন শুধু দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে।

জানা যায়, বগুড়া সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ৩০ দখলদারের এই তালিকা তৈরি করে উচ্ছেদের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠায়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হয়নি। বরং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দখলদারের তালিকা জনবহুল স্থানে টানানোর দাবি তুললেও তা আমলে নেয়নি প্রশাসন।

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পুরোনো নদীর মধ্যে ১২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ করতোয়া। জেলা প্রশাসনের তালিকায় নেই পুরোনো দখলদারদের নাম। পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলছেন, করতোয়া নদী দখলদারের নতুন তালিকা তৈরির আগে জেলা প্রশাসন ২৭ দখলদার চিহ্নিত করে উচ্ছেদ মামলা করেছিল। পরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে ৫ লাখ টাকা খরচও দেখানো হয়েছিল। তবে লোকদেখানো সেই অভিযানের পর আবারও উচ্ছেদ করা জায়গা দখলে নেয় পুরোনো সেই দখলদারেরা। উচ্ছেদ তালিকায় ছিল টিএমএসএস, বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতি ও হাসপাতাল, ব্যবসায়ী শংকর প্রসাদ (শংকর বাবু),আরাবিয়াতুল সালাফিয়া ওয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ, মোবারক ফতেহ আলী, শ্রীশ্রী জিউ বিগ্রহ গোপীনাথ মন্দির, আবুল কালাম আজাদ, খয়রতজ্জামান, রাধা প্রসাদ (রাধা বাবু), আবদুস সোবহান, কানাইলাল বসাক, এ কে এম ফজলুর রহমান, মুক্তার হোসেন, প্রদীপ কুমার রায়, আবদুল জলিল, সাইফুল ইসলাম, লাভলী বেগম, আবুল হোসেন, বজলার রহমান, কাশেম আলী, গোলাম মোস্তফা, কৃষ্ণা সাহা, আরতি রানী, আনন্দ কুমার, সঞ্জীব কুমার বিহানী, জোবাইদুল ইসলাম, মাজেদ হোসেন, মতিয়ার রহমান ও ফরিদ উদ্দিন।

এই তালিকার বাইরেও জেলা প্রশাসন কার্যালয় সংলগ্ন সূত্রাপুর মৌজার ১৭১৭ দাগে করতোয়া নদীর তলদেশের প্রায় ২৮ শতক জায়গা ভরাট করে পাকা ইমরাত নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগের সাবেক নারী সাংসদ কামরুন নাহারের ভাই খাজা একরামুল হক ও খাজা মোস্তাক গাউসুল হক। প্রশাসনের তদন্তে দখল প্রমাণ হওয়ায় সাত দিনের মধ্যে স্থাপনা উচ্ছেদ করতে নোটিশও জারি করা হয়েছিল। শহরের দত্তবাড়ি এলাকায় করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত চেলোপাড়া ক্রিসেন্ট সেতুসংলগ্ন কাটনারপাড়া মৌজায় নদীর তলদেশ ভরাট ও পাইলিং করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করেন ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন এবং এ কে এম জিল্লুর রহমান নামে দুই ব্যক্তি। প্রশাসন নোটিশ দিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধও করে দেয়। এ ছাড়া কিছুদিন আগে শহরের শেখ শরিফ উদ্দিন মার্কেট এলাকায় নদীর জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগের নেতা ও ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন। জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত তালিকায় এসব দখলদারের নাম নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) করতোয়া নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও করতোয়ার পানিপ্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখতে ২০১৫ সালের ২২ জুন বগুড়ার জেলা প্রশাসকসহ ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য বগুড়া জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নদীতে সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধে এবং দূষণরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন বগুড়া পৌরসভাকে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালীর খুলশীতে করতোয়া নদীর উৎসমুখে নির্মিত জলকপাটের পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয় করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আদালতের এসব আদেশ আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

এ বিষয়ে পাউবোর বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পানিপ্রবাহ ফেরাতে সিএস নকশা অনুযায়ী নদী খনন করা ছাড়াও পানি ধরে রাখার জন্য নদীর উৎসমুখে নতুন করে জলকপাট নির্মাণ, বগুড়া শহরে নদীর দুই তীরে ২৭ কিলোমিটার নালাসহ সড়ক নির্মাণ, তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণসহ ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন।