মেয়র নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট এবারই

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহ নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। ভোটাররা বলছেন, গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় তাঁরা ভোটের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে তাঁদের ভোটের গুরুত্ব নেই—এমন ধারণা থেকে তাঁরা এবার ভোট দিতে যাননি।

নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে ভোটারদের এমন অনাগ্রহকে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। আর বিএনপি দাবি করছে, জনগণ ভোট না দিয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানালেও সরকার ‘সিস্টেমের’ মাধ্যমে ৩১ শতাংশ ভোট দেখিয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে উপনির্বাচন গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অলস সময় কাটান। দু-তিন ঘণ্টা পরও একেকটি কেন্দ্রে ভোট পড়ে হাতে গোনা। নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে নিস্পৃহ ভাব ছিল প্রকট।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারবিহীন এই নির্বাচন ছিল আনুষ্ঠানিকতা। অতীতে ভোট দিতে গিয়ে জনগণ দেখেছে, তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, না হয় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল। ফলে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মনে চরম অনীহা তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের এমন অনাগ্রহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক না।

ইসি ঘোষিত চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী, ডিএনসিসি মেয়র উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২৬, যা মোট ভোটারের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। নির্বাচনে ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩০২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শাফিন আহমেদ পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪২৯ ভোট। বিজয়ী আতিকুল ছাড়া শাফিনসহ বাকি চার মেয়র প্রার্থীরই জামানত বাতিল হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত দেশের অন্য সিটি করপোরেশনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব নির্বাচনে কমপক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। গত বছর অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭৮ শতাংশ, সিলেটে ৭৫ শতাংশ, খুলনায় ৬২ শতাংশ, গাজীপুরে ৫৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১৫ সালে ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এবার ডিএনসিসি উপনির্বাচনে ভোট কম পড়ার পেছনে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অভিজ্ঞতার ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।

তবে ৩১ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দেওয়া হলেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যে প্রশ্ন আছে। এমনকি ২০১৫ সালের মূল নির্বাচনের সময়কার ভোটের হার নিয়েও সংশয় আছে।  

ডিএনসিসি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। গতকাল শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত র‍্যালি উদ্বোধনের সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদের জন্য উপনির্বাচন হওয়া, একটি বড় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এবং নির্বাচনের দিন প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। আমরা সন্তুষ্ট।’

ডিএনসিসি এলাকার ভোটার হয়েও নির্বাচনে ভোট দেননি এমন অন্তত ২০ জনের সঙ্গে গতকালকথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের প্রায় সবাই বলেন, ভোট দেওয়া নিয়ে কোনো আগ্রহ পাননি। কারও কারও ভাষ্য, আগের নির্বাচনগুলোর পরিস্থিতি দেখে তাঁরা এবার আর ভোটকেন্দ্রমুখী হননি।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাফর সাদিক বলেন, ‘আগের নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। যে দল বা প্রার্থীকেই ভোট দিই, একটি নির্দিষ্ট দলই জিতছে, এটাই মনে হচ্ছে। নিজের ভোটকে মূল্যহীন মনে হওয়ায় এখন আর নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ পাই না।’

মিরপুর এলাকার একজন মুদিদোকানি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ডিসেম্বরে যে নির্বাচন দেখছি তাতে আর ভোট দিতে যাওয়ার খায়েশ নাই। কে জিতব সেটা সবাই আগেই জানে। সরকারের এত টাকা খরচ না কইরা খালি ঘোষণা কইরা দিলেই পারত।’

তবে গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভোটের দিন এমনিতেই ছুটির দিন ছিল। অনেক ভোটার ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে, বড় একটি দল অংশ নেয়নি, দিনের শুরু থেকে বৃষ্টির বাগড়া ছিল। এ ছাড়া এটা একটি উপনির্বাচন। সব মিলিয়ে ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল।

নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই আবহাওয়া ছিল বৈরী। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন, বৃষ্টি কমলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। কিন্তু বেলা বাড়ার পর রোদ উঠলেও ভোটারের দেখা পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই উপনির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল অংশ না নেওয়ায় শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না।

ডিএনসিসি উপনির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে জনগণ ভোটের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গতকাল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানো শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই উপনির্বাচনে ভোটাররা কেন্দ্রে যায়নি, কেউ ভোট দেয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এত ভোট কোত্থেকে পেলেন? সরকার সিস্টেমের মাধ্যমে ৩১ শতাংশ ভোট দেখিয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে এই নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। অন্যদিকে গত সাধারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় জনগণের মনে হয়েছে, তারা ভোট দিল কি দিল না, তাতে ফলাফলে কিছু যাবে আসবে না। ক্ষমতাসীনেরা যে ফল চায়, তা তারা কোনো না কোনোভাবে তৈরি করবে। তাই জনগণ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।