ধলেশ্বরী-বংশী দখলদারের পেটে

দখলের কবলে সাভারের ঐতিহ্যবাহী বংশী নদী। নদীতীরের বিরাট এলাকাজুড়ে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন শত শত অবৈধ স্থাপনা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ব্রিজ এলাকায়।  ছবি: হাসান রাজা
দখলের কবলে সাভারের ঐতিহ্যবাহী বংশী নদী। নদীতীরের বিরাট এলাকাজুড়ে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন শত শত অবৈধ স্থাপনা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ব্রিজ এলাকায়। ছবি: হাসান রাজা

ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল, ১৯৯০ অনুযায়ী নদীর দুই ধারের যে অংশ শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তা ফোরশোর নামে অভিহিত। এই ফোরশোর এলাকায় কোনো ব্যক্তির অধিকার থাকে না। কেউ এই জমি দখল করলে তিনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এ আইন অমান্য করে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ধলেশ্বরী ও ঢাকার সাভারের বংশী নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। সাভারের নামাবাজার এলাকায় দখলের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

সিঙ্গাইর উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধলেশ্বরী নদীতীরের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সাভার উপজেলা প্রশাসন বংশী নদীর দখলদার উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
সিঙ্গাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ধল্লা, চরজলিল ও ফোর্ডনগর মৌজায় ধলেশ্বরী নদীর অন্তত ১১৫ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। ধল্লা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় থেকে এসব জমিতে থাকা ৯১ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে ৫০ জনের তালিকা। স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
সাভার উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সাভার ও বাগধনিয়া মৌজায় বংশী নদী দখল করে কয়েক শ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে মাত্র ৯৮ জন দখলদারের তালিকা তৈরি করা হলেও চার বছরে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কোনো পদক্ষেপ নেই।
সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রণব কুমার ঘোষ বলেন, দখলদারদের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।

দখল তালিকায় দলীয় নেতা ও প্রভাবশালী
ধলেশ্বরী ও বংশী দখলের তালিকায় সাংসদ, পৌর মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও তাঁদের স্বজনদের নাম রয়েছে।
সাভারের হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কের শহীদ রফিক সেতু পার হলেই ধল্লা-ফোর্ডনগর সড়ক। এই সড়ক ধরে কিছু দূর গেলেই মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ১১ দশমিক ৩০ একর ফোরশোর ও খাসজমি দখল করে ধলেশ্বরী নদীর তীরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
সরকারি জমিতে অনুপ্রবেশ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো নির্মাণের অভিযোগে ধল্লা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নুর ইসলাম মিয়া গত বছরের ১ জুলাই সিঙ্গাইর থানায় মামলা করেন। মামলায় ঢাকা নর্দান পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের পরিচালক মোস্তফা মঈন, মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপক আশিকুছ ছালাম ও সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান এবং জামির্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিমসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়।
পাওয়ার জেনারেশনের কয়েক শ ফুট পরেই রেজা কনস্ট্রাকশনের এসইএল ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। চরজলিল মৌজায় খান মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিনের মালিকানাধীন ওই ইটভাটার দখলে রয়েছে ২৩ দশমিক ৫৫ একর জমি। এসইএল ব্রিকস থেকে কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়বে নিলর্ন বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দখলেও সরকারি জমি আছে। তা ছাড়া এমএইচ ব্রিকসসহ দুটি ইটভাটা ও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দখল চোখ পড়ার মতো।
যোগাযোগ করা করা হলে রেজা কনস্ট্রাকশনের সিঙ্গাইর প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সড়কের দুই পাশেই আমাদের জমি। এখানে সরকারি জমি থাকলে সরকার নিয়ে নেবে। এতে সমস্যার কিছু দেখছি না।’
তালিকা অনুযায়ী এমএইচ ব্রিকসের দখলে রয়েছে ২ দশমিক ৫০ একর সরকারি জমি। কিন্তু ইটভাটার মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি জমি কিনে ইটভাটা দিয়েছেন। তাঁর দখলে কোনো সরকারি জমি নেই।
ধলেশ্বরী নদীর দখল বিষয়ে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস বলেন, ইতিমধ্যে অর্ধশত অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দখলদারদের আরও তালিকা তৈরি করে তাঁদের উচ্ছেদে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নদীর জায়গায় বাড়িঘর, স্থাপনা
সাভারের নয়ারহাট থেকে কর্ণপাড়া পর্যন্ত বংশী নদীর অন্তত ১০ কিলোমিটারজুড়ে দুই তীরে নদীর জায়গা দখল চলছে। সাভার পৌর শহর ও নয়ারহাট বাজারের কাছে দখলের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পৌর এলাকার নামাবাজারে নদীর অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পাকা, আধা পাকা বাড়িঘর, স্থাপনা। আরও স্থাপনা তৈরির জন্য তীর ভরাট করতে ফেলা হচ্ছে ইট-বালু ও আবর্জনা। এসব স্থাপনা করেছেন বা করছেন সরকারি দলের স্থানীয় নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
সাভার থানাসংলগ্ন নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে প্রায় পাঁচ একর সরকারি খাসজমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্প। নদীর অংশে পিলার দিয়ে প্রকল্পের এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। ওই প্রকল্পে সাভারের সাবেক সাংসদ তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও প্রভাবশালীদের প্লট রয়েছে।
সাভার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপদেষ্টা খন্দকার মোহাম্মদ হামিদ বলেন, কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা নদী দখল করে বাইরের লোকজনের কাছে তা বিক্রি করছেন।
বংশী নদীর দখল বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই জেলা প্রশাসন থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়, তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ অবৈধ দখলদারদের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। বরং বছর বছর দখলদারদের সংখ্যা বেড়েছে।