কংস ভরাট করে বসতবাড়ি

নালিতাবাড়ীর খলাভাঙা এলাকায় কংস নদ আড়াআড়ি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর। ছবিটি গত রোববার তোলা।  প্রথম আলো
নালিতাবাড়ীর খলাভাঙা এলাকায় কংস নদ আড়াআড়ি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর। ছবিটি গত রোববার তোলা। প্রথম আলো

শেরপুরের নালিতাবাড়ীর মরিচপুরান ইউনিয়নের খলাভাঙা এলাকায় ভোগাই নদের শাখা কংস নদ আড়াআড়ি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর। এতে করে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট এবং ফুলপুর এই তিন উপজেলার বাসিন্দারা। বাঁধ সরিয়ে নদটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। গত বছর ওই বাঁধ অপসারণের দাবি জানিয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। তবে কোনো কাজ হয়নি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী এবং কৃষি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার মরিচপুরান ইউনিয়নে খলাভাঙা এলাকায় ভোগাই নদ থেকে কংস শাখা নদটি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। এই শাখা নদটি ভোগাই নদ থেকে খলাভাঙা গ্রাম হয়ে হালুয়াঘাট উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের গোরকপুর, চর গোরকপুর, মাইছপাড়া, রামনগর, জয়তক, ডুয়ারপাড়, ঝাইগড়া, আমতৈল এবং বাহিরশিমুল হয়ে ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার ঘুরে ফুলপুর উপজেলার সরচাপুর গিয়ে পুনরায় ভোগাই নদে গিয়ে মিশেছে।

এই শাখা নদের পানি দিয়ে সংলগ্ন গ্রামের হাজার হাজার কৃষক খেতে সেচ দিতেন। এ ছাড়া নদের পানিতে গৃহস্থালির কাজ, গবাদিপশুর গোসল করানোসহ নানান কাজে এই নদের পানি ব্যবহার করতেন গ্রামবাসী। ২০১৬ সালে নদে শুষ্ক মৌসুমে পানি মজুত রাখতে খলাভাঙা এলাকায় এই নদে একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে জলকপাটের দুই পাশের মাটির বাঁধ ভেঙে যায়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নদের উৎসমুখ থেকে ২০০ মিটার ভাটিতে মরিচপুরান ইউনিয়নের খলাভাঙা এলাকায় আয়নাল হক, নাজমুল হক এবং আঞ্জুয়ারা বেগম নদ ভরাট করে বাড়িঘর তোলেন। ওই বছরের মার্চে এলাকাবাসী নদে দেওয়া বাঁধ সরানোর দাবি জানিয়ে নালিতাবাড়ীর ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তখন ইউএনও মরিচপুরান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খন্দকার শফিক আহমেদকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন। প্রথম দিকে বাঁধ সরাতে জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গত বছরের এপ্রিলে নদের ৪০ শতাংশ জমি ভরাট করে সেখানে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। নদ ভরাট করায় ভাটিতে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।

গত রোববার সরেজমিনে কংস নদের ১০ কিলোমিটার ঘুরে দেখা গেছে, খলাভাঙা গ্রামের মধ্যখান দিয়ে কংস শাখা নদ দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। স্লুইসগেটের ২০০ মিটার ভাটিতে নদের ওপর আড়াআড়ি করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সেই বাঁধের ৪০ শতাংশ জমিতে মাটি ফেলে ভরাট করে তিনটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদের ভাটির দুই পাড়ের মানুষ এ প্রতিনিধির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
খলাভাঙা এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন (৯০) প্রথম আলোকে বলেন, উজানে বাঁধ দেওয়ায় নদের ভাটি অঞ্চলের মানুষের বিরাট ক্ষতি হয়েছে।

মরিচপুরান ইউপির সাবেক সদস্য ওয়াজেদ আলী বলেন, গত বছর নদের উজানে কয়েক জন বাঁধ দিয়ে নদের পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। বাঁধ সরাতে এলাকাবাসী ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। ইউপি চেয়ারম্যান সরেজমিনে গিয়ে বাঁধ দেখেছেন। কিন্তু এরপরও কোনো কাজ হয়নি। নদে বাঁধ দেওয়া আয়নাল হক ও নাজমুল হক দাবি করেন, ‘এই জমি আমরা এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নিয়ে মাটি ফেলে ভরাট করে বাড়িঘর করেছি। এখন আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দিতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

হালুয়াঘাটের ধুরাইল ইউপির চেয়ারম্যান মো. ওয়ারিছ উদ্দিন বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নালিতাবাড়ী ও হালুয়াঘাট উপজেলার নদে দুই পাড়ের হাজার হাজার কৃষক তাঁদের জমিতে সেচ দিতে পারতেন। নদের উজানে বাঁধ দেওয়ায় সেই পানি বন্ধ হয়ে গেছে। বাঁধ সরিয়ে খননের মাধ্যমে আবারও নদের নাব্যতা ফিরে আনার দাবি জানান তিনি।
মরিচপুরান ইউপির চেয়ারম্যান খন্দকার শফিক আহম্মেদ বলেন, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর আমি খলাভাঙা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আকবর স্যারকে নিয়ে ঘটনাস্থল দেখতে গিয়েছিলাম। পরে আলী আকবর স্যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে বাঁধটি সরিয়ে দেওয়া হবে। শুনেছি এখনো বাঁধটি সরানো হয়নি। বিষয়টি আমি দ্রুত ইউএনওকে জানাব।’ আলী আকবর বলেন, যাঁরা নদ ভরাট করে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন তাঁরা সবাই গরিব। বাঁধ সরাতে তাঁদের কাছে কোনো টাকাপয়সা নেই বলে জানিয়েছিলেন। এখন তাঁরা বাড়িঘর ফেলে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। যদি প্রশাসনিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে বাঁধ সরাতে কোনো বাধা থাকবে না।
ইউএনও মো. আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আপনার মাধ্যমেই প্রথম শুনলাম। বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। দ্রুত সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে নিয়ে নদ থেকে বাঁধ সরানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’