দখল-দূষণে এগিয়ে টিএমএসএস
>• করতোয়ার বগুড়া শহরের অংশেই অবৈধ দখলদার কয়েক শ
• আদালত ও নদী কমিশনের নির্দেশ শর্তেও জেলা প্রশাসন একটি দায়সারা তালিকা করেছে
• সর্বশেষ তালিকার তিনটি স্থানে দখলদার হিসেবে টিএমএসএসের নাম আছে
• দখলদারের তালিকায় আরও আছে বগুড়া পৌরসভা, বগুড়া ডায়াবেটিক হাসপাতালের নাম
করতোয়া নদী দখল ও দূষণে অন্তত ৫০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার কথা বলছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। আর সবচেয়ে বেশি অভিযোগ বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) বিরুদ্ধে। সংস্থাটির বিরুদ্ধে নদীর জায়গায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও গতিপথ পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি বর্জ্য ফেলে ভরাট ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীদূষণের অভিযোগও আছে। নদীর বুকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার যন্ত্র বসিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের তথ্য উঠে এসেছে প্রশাসনের প্রতিবেদনেও।
জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ৩০ দখলদারের তালিকা প্রকাশ করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলীমূন রাজীব বলেন, তালিকায় থাকা দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করে সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়ে নিজ থেকে স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এরপর উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। আরও দখলদার চিহ্নিত করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা কমিটির সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, করতোয়ার বগুড়া শহরের অংশেই অবৈধ দখলদার কয়েক শ। সিএস নকশা অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ এবং দখলদারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন। আদালত ও নদী কমিশনের নির্দেশ শর্তেও জেলা প্রশাসন একটি দায়সারা তালিকা প্রকাশ করেছে।
সর্বশেষতালিকার তিনটি স্থানে দখলদার হিসেবে টিএমএসএসের নাম আছে। দুটি জায়গায় নাম রয়েছে বগুড়া পৌরসভার। এ ছাড়া দখলদারের তালিকায় বগুড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল, গোপীনাথ মন্দির ও সাহেববাজার বায়তুল হামদ জামে মসজিদ আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে জহুরুল ইসলাম ঘাটসংলগ্ন এলাকায় টিএমএসএস মহিলা মার্কেটের পেছনের অংশে নদী ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে টিএমএসএস। ঠেঙ্গামারা এলাকায় টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের পেছনে মহিষাবান মৌজায় প্রায় ১৫ বিঘা আয়তনের করতোয়া নদীর পাড় দখল ও মাটি ভরাট করে দুটি ছাত্রীনিবাস এবং একটি ক্যানটিন নির্মাণ করা হয়েছে।
করতোয়া ছাত্রীনিবাস–সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের একটি কালভার্টের নিচে গিয়ে দেখা গেল, মাটির নিচ দিয়ে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে নদীতে অবিরাম ফেলা হচ্ছে কালো রঙের ঘন তরল বর্জ্য ও দূষিত পানি। স্থানীয় তিনজন ব্যক্তি অভিযোগ করেন, বিসিএল পেপার মিলে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে। তবে তা অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হয়।
ছাত্রাবাস থেকে দক্ষিণ দিকে একটু এগিয়ে পাশের আরেকটি স্থানে নদীর জায়গা ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে ক্যানটিন। সেখানে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলতে দেখা গেল টিএমএসএসের কর্মীদের। অদূরে টিএমএসএসের নির্মাণাধীন ইকোপার্কে গিয়ে দেখা গেল, নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। নদীর বুকে খননযন্ত্র বসিয়ে বালু ফেলা হচ্ছে ইকোপার্কে।
ইকোপার্কের পূর্ব পাশে স্রোতোধারা বাধাগ্রস্ত করে নদীর মাঝখানে প্রায় দুই বিঘা আয়তনের জায়গা ভরাট করে বসার আসন তৈরি করা হয়েছে। ইকোপার্ক থেকে সেখানে যাতায়াতের জন্য নদীতে খুঁটি পুঁতে ও প্লাস্টিকের ড্রাম ফেলে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের ঝুলন্ত সেতু। ইকোপার্কের উত্তর ধারে টিএমএসএসের ট্রাক থেকে নদীতে ফেলতে দেখা গেল পলিথিন, প্লাস্টিকসহ শুকনো বর্জ্য। একজন ট্রাকচালক বলেন, বর্জ্য ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে করতোয়ার পারে ছাত্রীনিবাস ও ক্যানটিন নির্মাণ করা হয়েছে। পেপার মিলের বর্জ্য নদীতে ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, পেপার মিলে ইটিপি চালু রয়েছে। কালভার্টের নিচে নর্দমা দিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টের তরল বর্জ্য ফেলা হতে পারে। তিনি দাবি করেন, নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতেই পরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। নদীর স্রোতোধারা বাধাগ্রস্ত করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, নদীর বুকে দ্বীপের আদলে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন স্থানটি টিএমএসএসের নিজস্ব জায়গা, নদীর সীমানা দ্বীপের ওপারে। এ ছাড়া টিএমএসএসের বেশ কিছু জায়গা করতোয়ায় বিলীন হয়েছে। এসব জায়গা ভরাট করতে নদীর ধারে শুকনো বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।
বগুড়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তমাল হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরে খোঁজখবর নিয়ে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে করতোয়া নদীর একাধিক স্থানে দখল, ভরাট ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের প্রমাণ মিলেছে।
তালিকার বাইরেও জেলা প্রশাসন কার্যালয়–সংলগ্ন সূত্রাপুর মৌজার ১৭১৭ দাগে করতোয়ার প্রায় ২৮ শতক জায়গা ভরাট করে পাকা ইমারত নির্মাণ করেছেন সাবেক সাংসদ কামরুন নাহারের ভাই খাজা একরামুল হক ও খাজা মোস্তাক গাউসুল হক। প্রশাসনের তদন্তে দখল প্রমাণিত হওয়ায় সাত দিনের মধ্যে স্থাপনা উচ্ছেদ করতে নোটিশও জারি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, করতোয়া দখল ও দূষণ বন্ধে প্রশাসনের সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা ও সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। নদী দখল ও দূষণকারী এবং বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় করতোয়ার প্রাণ ফেরানো যাচ্ছে না।