পাঁচ বিদ্রোহীর প্যাঁচে জাহাঙ্গীর

>

• উপজেলা পরিষদ নির্বাচন
• মনোনয়নবঞ্চিত তিনজনসহ পাঁচজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী
• এক বিদ্রোহী তাঁর স্ত্রী ও বাবাকেও ‘ডামি’ প্রার্থী করেছেন

গোলটা বেধেছিল প্রথম সভাতেই। চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নাম বাছাইয়ের জন্য তৃণমূলের সভা। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাইয়ের চেষ্টা চলে। এক পক্ষের বাধায় পণ্ড হয়ে যায় সভা। এরপর পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার। শেষতক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হয়। কেন্দ্রে নাম পাঠানো হয় পাঁচজনের। কেন্দ্র দলীয় মনোনয়ন দেয় একজনকে। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় দেখা গেল, মনোনয়নবঞ্চিত তিনজনসহ পাঁচজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। এক বিদ্রোহী তাঁর স্ত্রী ও বাবাকেও ‘ডামি’ প্রার্থী করেছেন।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের এ অবস্থা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। এখানে দলীয় প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল বাছির, তাঁর ছেলে পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম আহমদ, শামীমের স্ত্রী জরিনা বেগম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াকুব আলী।

জাহাঙ্গীর আলম, চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, কোম্পানীগঞ্জ
জাহাঙ্গীর আলম, চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, কোম্পানীগঞ্জ

সিলেটের ১২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচন হবে ১৮ মার্চ। আওয়ামী লীগ মাত্র দুটিতে এককভাবে দলীয় প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ১০টিতে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন এক থেকে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী। সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন এই কোম্পানীগঞ্জেই। ভোটের রাজনীতিতে এক জাহাঙ্গীরকে ঘিরে এ অবস্থা আওয়ামী লীগে ‘পাঁচ বিদ্রোহীর প্যাঁচ’ বলে অভিহিত হচ্ছে।
কোম্পানীগঞ্জ সিলেটের ‘পাথররাজ্য’ হিসেবে পরিচিতি। কোয়ারিতে যত্রতত্র পাথর উত্তোলন, অবৈধ বোমা মেশিন ও শাহ আরেফিন টিলায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন নিয়ে একটি চক্র সক্রিয় থাকে। এ চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় স্থানীয় নির্বাচনগুলো। বিষয়টি প্রকাশ্য হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইয়ের ওই সভাতেও।

গত ২৯ জানুয়ারি উপজেলা আওয়ামী লীগের ওই বর্ধিত সভায় হট্টগোল হওয়ার পেছনে ছিল একক প্রার্থী করা নিয়ে দ্বন্দ্ব। চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম আহমদের বিরুদ্ধে। তাঁকে একক প্রার্থী করতে গোপন ব্যালটে ভোট আহ্বান করা হয়েছিল। বাধা পেয়ে শেষে সভা পণ্ড হয়। শামীমের বিরুদ্ধে পাথর কোয়ারি এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি ও অবৈধ বোমা মেশিন চালিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসনের টাস্কফোর্স অভিযানের একাধিক মামলা রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলছেন, কেন্দ্র থেকে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জাহাঙ্গীরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। আর একাধিক ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ার পেছনে রয়েছে পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি।

অন্য দুই বিদ্রোহী স্পষ্ট করে কিছু না বললেও শামীম আহমদ তাঁর সপরিবারে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। গত বুধবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনিই আসল প্রার্থী। তাঁর স্ত্রী জরিনা বেগম ও বাবা আবদুল বাছির তাঁর প্রার্থিতা যাতে বাতিল না হয়, এই কৌশলগত কারণে প্রার্থী হিসেবে থাকছেন। তাঁকে দলীয় প্রার্থী না করে আওয়ামী লীগ ভুল করেছে দাবি করে শামীম বলেন, ‘আমরা নৌকাকে ডোবাতেই প্রার্থী হয়েছি। দেখবেন, নৌকা হারবে, আর আমিই জিতব।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে এ নিয়ে টানা তিনবার নির্বাচন করছেন। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকায় ২০০৮ ও ২০১৪ সালে দল–সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। দলীয় প্রতীকে এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন। তাঁকে ঘিরে পাঁচজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়া সম্পর্কে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন ব্যক্তি নই, দল। আমার বিজয়ের মধ্য দিয়ে দলের বিজয় হবে। সুতরাং নৌকাকে বিজয়ী করার চেষ্টা থাকতে হবে দলের সব পর্যায়ের কর্মীর মধ্যে। যাঁরা দলীয় প্রার্থী ও দলীয় প্রতীকের বিরোধিতা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দলের ভূমিকা রাখা চাই। তবে নির্বাচনটি উপজেলা আওয়ামী লীগ পরিচালনা করছে। তাই বিষয়টি জেলাকে জানিয়ে প্রতিকার চাওয়া হবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, বিএনপি না আসায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা আছে। তাই আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে একধরনের ছাড়ের মনোভাব নিয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রও অনেকটা একই মনোভাব পোষণ করায় জেলা থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

সিলেট জেলায় তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে জরুরি সভা ডাকা হবে।