দেশের ৬৬ ভাগ ইলিশের জোগান বরিশাল থেকে

ইলিশ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ইলিশ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

•বরিশাল থেকে এসেছে ৬৬ শতাংশ ইলিশ
•সবচেয়ে বেশি ইলিশের জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা
•নানামুখী উদ্যোগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে

বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয় প্রায় ৪ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু বরিশাল বিভাগ থেকে এসেছে প্রায় ৬৬ শতাংশ ইলিশ। পরিমাণে যা ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসার পেছনে বরিশাল অঞ্চলের এই ইলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের ৯ জুলাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই বছর আগেও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এখন দুই ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয়। এই অগ্রগতির পেছনে মূল অবদান ইলিশের। শুধু ইলিশই নয়, প্রাকৃতিক চাষকৃত উৎসের অন্যান্য মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল।

পরিসংখ্যানে যা পাওয়া যায়
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলিশের জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা। ভোলায় গত অর্থবছরে ইলিশ আহরিত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৩২ মেট্রিক টন ও বরগুনায় আহরিত হয় ৭০ হাজার ২৩৭ মেট্রিক টন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ৯ বছরে এই বিভাগ ইলিশ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বৃদ্ধির হার প্রায় ১১০ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিভাগে ইলিশ আহরিত হয় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টনে। এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টনে ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আহরণ কিছুটা কমলেও তার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৮১ মেট্রিক টন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা অনেক বেড়ে আহরণ হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন।
মৎস্য বিভাগ বলছে, বিভাগে গত অর্থবছরে ইলিশ ও অন্যান্য মাছ আহরিত হয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে প্রাকৃতিক উৎসের বিভিন্ন মাছ এবং চাষ করা মাছের উৎপাদন প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬২ মেট্রিক টন। বিভাগে মাছের চাহিদা ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪০ মেট্রিক টন। চাহিদা পূরণ করে ২ লাখ ১৬ হাজার ১৪৭ মেট্রিক টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকছে।
মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, দেশের মৎস্য খাতে বরিশাল এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

যেভাবে বেড়েছে উৎপাদন
ইলিশের উৎপাদন বাড়ার পেছনে নানামুখী উদ্যোগ কাজ করেছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। ইলিশ রক্ষায় সরকার ও মৎস্য বিভাগ এবং জেলে, ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি যত্নশীল হয়েছেন। আগে ইলিশ সংরক্ষণ, এর জীবনাচার নিয়ে দেশে তেমন কোনো গবেষণা, পরিকল্পনা ছিল না। এখন নানামুখী কাজ হচ্ছে, গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করা হচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইলিশের অভয়াশ্রম বাড়ানো হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা ধরায় আট মাসের নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়িভাবে মানা হচ্ছে। এ সময়ে জাটকা ও মা ইলিশ ধরা প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে ইলিশ নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারছে। ফলে পোনা ও জাটকা বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাচ্ছে। দেশের নদ-নদীতে সারা বছর ইলিশ মিলছে। এটা আশার খবর। যেভাবে ইলিশ নিয়ে কাজ চলছে, তাতে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে, এমন আশাও করছেন তাঁরা।

ইলিশ রক্ষায় প্রকল্প
উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের আট জেলায় ‘ইকো ফিশ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদপ্তর। এর আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো ইলিশের বংশবিস্তার ও প্রজননকাল নির্ধারণসহ নানা দিক নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের মার্চে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। এতে মৎস্য অধিদপ্তরকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ’।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০১ সাল থেকে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। এরপর নানামুখী উদ্যোগে ইলিশ আহরণ কিছুটা বাড়ে। তবে ২০১৪ সালের পর এর পরিমাণ অনেকটা বাড়ে। ২০১৬ সালে যেখানে দেশে ইলিশ আহরণের হার ছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার, সেখানে তার পরের বছর থেকে তিন বছরে ধরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টনে। এটা সম্ভব হয়েছে ইলিশ নিয়ে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেওয়ায়।

প্রথমেই প্রকল্পভুক্ত জেলাগুলোর জেলেদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ১২৬টি জেলে-অধ্যুষিত গ্রামকে চিহ্নিত করা হয়। এরপর গ্রামের জেলে, তাঁদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নানা আয়বর্ধক কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা দেওয়া হয়। জেলেরা প্রতিজ্ঞা করেন যে, তাঁরা নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরবেন না, মা ইলিশ ও জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকবেন। প্রকল্পে গবেষকদের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ এলাকায় একটি ইলিশের অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পভুক্ত এলাকায় ৪০০ ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ ও ভাতা দিয়ে ফিশগার্ড নিয়োগ করে জনসচেতনতা ও ইলিশ রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় উপকূলের ইলিশ মাছ অতিমাত্রায় আহরণ থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং তা বড় হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদন অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। এতে ইলিশ মাছের পাশাপাশি অন্য মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেয়ে সেসব উৎপাদনও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে। প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে এই প্রকল্প কাজ সম্প্রসারণ করা গেলে ভালো হতো। তাহলে আমাদের প্রণীত কর্মপরিকল্পনার কাঠামোটি টেকসই হতো।’