আলপথ ধরে বহুদূর

আমেনা আক্তার
আমেনা আক্তার

গ্রামের আলপথ ধরে যেত স্কুলে। পরে শহরের স্কুলে ভর্তি। পরিবার ছাড়া থাকতে হয় হোস্টেলে। এরই মধ্যে দেখিয়েছে তাক লাগানো সব সাফল্য। ২০১৮ সালে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হয় সে। এর পুরস্কার হিসেবে আসছে ১৪ এপ্রিল জাপান সফরে যাচ্ছে মেয়েটি।

এবার এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যেই বসেছে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডের আসর। এই পরীক্ষায়ও অংশ নিল সে। ফলাফল—মেয়েদের মধ্যে সারা দেশে প্রথম। আমেনা যেতে চায় আরও বহুদূর।

এই মেয়েটি আমেনা আক্তার। সে এবার কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তার বাড়ি মনোহরগঞ্জ উপজেলার লত্সর গ্রামে। বাবা মো. আলমগীর হোসেন মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কম্পিউটার অপারেটর। আর মা উদাইশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, আমেনা দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করে। গ্রামের আলপথ ধরে স্কুলে যেত। এখান থেকে মেধাবৃত্তি পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) শেষ করে সে। এরপর বাবা-মা তাকে নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে। কিন্তু কুমিল্লা শহরে তার থাকার জায়গা ছিল না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ষষ্ঠ শ্রেণিতেই ছাত্রীনিবাসে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এখান থেকে অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায়ও মেধাবৃত্তি পায় সে। এবার এখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে আমেনা।

আমেনা বলে, ‘কুমিল্লা থেকে চারটি উপজেলা পেরিয়ে অন্তত ৪০ কিলোমিটার দূরে আমার বাড়ি। আমার মা প্রতি ছুটির দিনে কুমিল্লায় এসে আমাকে দেখে যেতেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার, সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার ও বাবা-মার কাছে আমার অনেক ঋণ।’

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবারের লোকজন জানান, আমেনা গণিত বড় বেশি ভালোবাসে। গণিত তার প্রিয় বিষয়। ২০১৬ সালে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবে কুমিল্লা অঞ্চলের জুনিয়র ক্যাটাগরিতে প্রথম রানার আপ হয় সে। ২০১৭ সালে একই ক্যাটাগরিতে হয় চ্যাম্পিয়ন। ২০১৯ সালে সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে সে প্রথম রানার আপ হয়। এবার এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেই সে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে গণিত উৎসবে অংশ নেয়। ১ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে হয় এ উৎসব। এতে সে সারা দেশের মধ্যে মেয়েদের ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছে।

আমেনার মা রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে কেউ কোথাও বের হয় না। মেয়ে জেদ করল, সে গণিত উৎসবে যাবে। আমরা তাকে নিয়ে গেলাম। পরের গল্পটা তো আপনারা জানেনই।’

এ বিষয়ে আমেনা বলে, ‘২ মার্চ আমার এসএসসির জীববিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। তার আগের দিন জাতীয় গণিত উৎসব। ২৮ ফেব্রুয়ারি বাবা-মাকে নিয়ে আমি জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য ঢাকায় যাই। ১ মার্চ অলিম্পিয়াড শেষ হওয়ার পর বিকেল পাঁচটার দিকে মাকে নিয়ে কুমিল্লায় চলে আসি। অলিম্পিয়াড ভালো হয়েছে, তাই বাবাকে পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় থাকতে বলি। পরে দেখি, মেয়েদের ক্যাটাগরিতে আমি প্রথম হয়েছি।’

বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, আমেনা ২০১৮ সালে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় গণিত ও কম্পিউটার বিষয়ে প্রথমে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলায় প্রথম হয়। এরপর জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়। পরে ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে সে সেরা হয়। এরপর ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুরস্কার দেন। আগামী ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের আরও ১৫ জন শিক্ষার্থীসহ সে জাপানে যাবে। সেখানে এক সপ্তাহ থাকবে তারা।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার বলেন, ‘মেয়েটি লক্ষ্য ঠিক করে এগিয়ে যাচ্ছে। পারতেই হবে, করতে হবে—এমন স্পৃহা ওর মধ্যে দেখা যায়। ও এখন আমাদের বিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত।’

আমেনার স্বপ্ন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) পড়ার। গণিতের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য তার ভালো লাগে। অবসরে বই পড়া তার শখ। তার বিশ্বাস, এ দেশের সব সূচকেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের বঞ্চিত ও উপেক্ষিত নারীদের জন্য কাজ করতে চায় সে।