র্যাগিংয়ের নামে যৌন নিপীড়ন, ৯ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ১২জন নবীন শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিংয়ের নামে যৌন নিপীড়নের দায়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের নয়জন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি জানায়, র‌্যাগিংয়ের শিকার হওয়া একজন ছাত্র ঘটনার পর থেকে এখনো চিকিৎসাধীন। ভুক্তভোগী অন্য ছাত্ররা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এবং স্বাভাবিক হতে পারছেন না।

আজ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। পৃথক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বহিষ্কৃত এসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হবে।

বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে আজীবন বহিষ্কৃত হয়েছেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অলি উল্লাহ ও মাহমুদুল হাসান; দুই বছরের জন্য বহিষ্কৃত চতুর্থ বর্ষের রজিবুল হক রজব এবং এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত চতুর্থ বর্ষের আবদুল কাদের, দ্বিতীয় বর্ষের আল মুজাহিদ আফ্রিদি, শহিদুল ইসলাম, রোকনুজ্জামান রোকন, অনুপ মালাকার ও শামীম বিশ্বাস।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আমবটতলা ও যশোর শহরের পালবাড়ি এলাকার দুটি ছাত্রাবাসে ১২ জন শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে র‌্যাগিং দেওয়া হয়। এ সময় তাঁদের কাউকে কুকুরের মতো, কাউকে মুরগির মতো আবার কাউকে চেয়ার ছাড়া চেয়ারে বসতে বলা হয়। দুই ছাত্রকে যৌন মিলনের মতো অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করা হয়। অপর দুজনকে শুধু অন্তর্বাস পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে নানা ধরনের যৌন নিপীড়ন চালানো হয়। তাদের সবার কাছ মোবাইলও ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

র‌্যাগিং এর সময় একজন ছাত্রের খিঁচুনি হয়। অপর একজনের নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। তারা এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে ওই দুই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাননি।

এ ঘটনার পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, আরও ১১ জনকে একই ধরনের বিকৃত যৌনাচারে বাধ্য করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, র‌্যাগিংয়ের নামে যৌন নিপীড়ন এবং বিকৃত যৌনাচারে বাধ্য করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি ভুক্তভোগী ১২ জনসহ মোট ৪০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পায়। এ ঘটনায় জড়িত ছাত্ররা তদন্ত কমিটির সঙ্গে অসংলগ্ন ও ঔদ্ধত্য পূর্ণ আচরণ করেন। এমনকি তারা এ বিষয়ে অনুতাপ বা দুঃখ প্রকাশও করেনি। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করলে ভয় দেখিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। এ সংক্রান্ত ফোন কলের রেকর্ডও তদন্ত কমিটির হাতে রয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাগিংয়ের শিকার হওয়া একজন ছাত্র ঘটনার পর থেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ভুক্তভোগী অন্য ছাত্ররা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এবং স্বাভাবিক হতে পারছেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে র‌্যাগিং রোধ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আচরণবিধি অনুযায়ী দোষীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

এ অপরাধের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু বক্কর সিদ্দিকী, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শতদল পাল ও ইমরান হোসেনকে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে র‌্যাগিংসহ শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবে না- এ মর্মে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাদের আইনানুগ অভিভাবকগণ এবং তারা নিজেরা ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকার না করলে তাঁদেরও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে জানানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ ও ৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে র‌্যাগিং বিরোধী ব্যানার টাঙায়। র‌্যাগিং-এ মদদদাতা কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী ওই ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এর প্রতিবাদ করলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ইকবাল কবির জাহিদকে মুঠোফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিবাদে গত ১২ জানুয়ারি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচির পালন করেন। এ সময় ওই শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনে হামলা করেন। হামলার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি পালন করেন। উপাচার্যের ন্যায় বিচারের আশ্বাসে শিক্ষকেরা রিজেন্ট বোর্ড পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রিজেন্ট বোর্ডের সভায় ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪টি বিভাগের মধ্যে ২০ বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে শিক্ষকেরা পদত্যাগ করেন। আগামী রিজেন্ট বোর্ডে ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে মে মাসের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন ও প্রশাসনিক সব পদ থেকে শিক্ষকেরা পদত্যাগ করবেন বলে শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাগিং এর নামে নবীন শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করল জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা।