ছাত্রলীগ নেতা সোহেলকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়

মহিউদ্দিন সোহেল
মহিউদ্দিন সোহেল

রাস্তায় পিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেলকে খুন করা হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ববিরোধের জেরে এই খুনের ঘটনা। মাইকে ছিনতাইকারী এসেছে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করেন হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা। এই ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার এক আসামি ও প্রত্যক্ষদর্শী এক সাক্ষীর জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে আসে। দুই মাস তদন্তের পর পুলিশও এটি নিশ্চিত হয়। নিহত সোহেল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপশিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক।

গত ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে মহিউদ্দিন সোহেলকে খুন করা হয়। এ সময় ব্যবসায়ীরা প্রায় দুই ঘণ্টা দোকান বন্ধ রাখেন। এই বাজারে পাইকারি ও খুচরা মিলিয়ে সাড়ে ছয় শ দোকান রয়েছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পর এটি চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার। খুনের ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই শাকিরুল ইসলাম বাদী হয়ে পরদিন রাতে নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করেন। এতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাবের আহম্মদ সওদাগর ও নগর জাতীয় পার্টির সহসভাপতি ওসমান খানকে প্রধান আসামি করে ২৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। প্রধান দুই আসামিই পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজার কমিটির নেতা। আসামি মোবারক হোসেন আদালতে গত মাসে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আর সাক্ষী হিসেবে বিচারিক জবানবন্দি দেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ব্যক্তি।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) ফারুক উল হক প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে মহিউদ্দিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মাইকে ছিনতাইকারী ঘোষণা দিয়ে গণপিটুনি বলে প্রচার করা হলেও সবই পরিকল্পিত। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। আসামি ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

যেভাবে খুন
আদালত সূত্র জানায়, দুজনের জবানবন্দিতে মহিউদ্দিন সোহেলকে খুনের পুরো চিত্র উঠে আসে। ঘটনার দিন সকালে পাহাড়তলী বাজারে মহিউদ্দিন সোহেলের অফিসের বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ করে দেন ওসমানের নেতৃত্বে আসামি সেলিম মাঝি ও জামাল মাঝি। মহিউদ্দিন সোহেল তাঁর সহযোগী মো. লিটন ও শাহাজাহানকে নিয়ে পাওয়ার হাউসে যান। সেখানে ওসমান, বাবু, জুয়েল, রুহুল আমিন, রাসেল, টেডি দিদারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এদের মধে৵ টেডি দিদার আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। বাকিরা বিএনপির কর্মী। সবাই ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে মাথায় আঘাত পান ওসমান ও মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন তাঁর অফিসে চলে যান।

মাথায় রক্ত নিয়ে ওসমান পাহাড়তলী বাজারে ঘুরতে থাকেন। আর ব্যবসায়ী সমিতির মাইকে বলতে থাকেন ‘বাজারে ছিনতাইকারী এসেছে। যার যা আছে তা নিয়ে রাস্তায় নেমে আস।’একপর্যায়ে দোকানপাট বন্ধ করতে ব্যবসায়ীদের মাইকে অনুরোধ করেন ওসমান। এতে ৪০০ থেকে ৫০০ লোক জড়ো হয়ে যায়। ওসমান খানের নেতৃত্বে কয়েক শ লোক মিছিল করতে থাকে। একপর্যায়ে মহিউদ্দিনের অফিসটি ভাঙচুর করা হয়। ১৫ মিনিট পর মিছিলটি ঘুরে পুনরায় মহিউদ্দিনের অফিসে আসে। পুনরায় ভাঙচুর করা হলে মহিউদ্দিন পাশে রেলের কোয়ার্টারে একটি বাসায় চলে যান। রাসেল মির্জা, জুয়েল মির্জা, টেডি দিদার, মনা, জাবেদ ওই বাসায় ঢুকে মহিউদ্দিনকে মারতে মারতে তাঁর অফিসের সামনে নিয়ে আসেন।

জবানবন্দিতে রয়েছে, ঘটনার সময় টেডি দিদার, মনা ও রাসেলের হাতে টিপ ছুরি, বাবুর হাতে খুন্তি, শাহাবুদ্দিনের হাতে লোহার রড, মামুনের হাতে লাঠি, জামাল মাঝি, রশিদ মাঝির হাতে বস্তা টানার হুক ছিল। ওসমান খান, সেলিম মাঝি ও রুহুল আমিন ওই সময় সবাইকে বলতে থাকেন মহিউদ্দিন সোহেলকে যেভাবে পার মারতে থাক। তাঁরা তাঁকে ছুরি, কাচের বোতল,ইট, কাঠের স্ট্যাম্প, খুন্তি, লোহার রড দিয়ে মারতে থাকেন। রক্তাক্ত অবস্থায় মহিউদ্দিন রাস্তায় পড়ে থাকলে রাসেল মির্জা, সেলিম মাঝি, জামাল মাঝি, রশিদ মাঝি মিলে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাজারের দিকে নিয়ে যান। পরে পেট্রল ঢেলে মহিউদ্দিনের অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় অফিসে ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে যান আসামি মোবারক হোসেন।

যেকারণে খুন
জবানবন্দিতে রয়েছে, দুই যুগ ধরে পাহাড়তলী বাজারে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন ওসমান খান। ওসমানের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন সোহেল পাহাড়তলী বাজারে আসার আগে চশমা ফারুক, ফরিদ ও মনসুর এটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত বছরের মার্চে একটি খুনের মামলায় মনসুর কারাগারে গেলে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন মহিউদ্দিন সোহেল। এরপর তিনি সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠা দোকান ও ঘর তুলে দিয়ে সেখানে সেখানে জানাজার মাঠ করেন। ওখানে দোকান ছিল আসামি শাহাবুদ্দিন, মামুন ও রশিদ মাঝিসহ ১১ জনের। পাশে নিজের জন্য একটি অফিসও করেন। অফিসে বসে সালিস–বিচার করতেন। এসব নিয়ে কিছু মানুষের ক্ষোভ ছিল মহিউদ্দিনের ওপর।

মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই শাকিরুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁর ভাই চাঁদাবাজ নন। কাউন্সিলর সাবের আহম্মদ, ওসমান খান চাঁদাবাজি করতেন। এগুলো বন্ধ করায় তাঁর ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

 পলাতক রয়েছেন সরাইপাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবের আহম্মদ। তাঁর স্ত্রী নগর মহিলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহানারা বেগম দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর স্বামী জড়িত নন।