দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা, চাপে পড়বে মানুষ

>

• গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিইআরসি
• এলএনজি আমদানির পর দাম বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমিত ছিল
• বিতরণকারীদের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব আঁতকে ওঠার মতো
• সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ১০৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব
• সব মিলিয়ে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়, উসকে দেবে মূল্যস্ফীতি

নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে শিল্পোদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। তাঁরা হিসাব কষছেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে কারখানার উৎপাদন খরচ কতটা বাড়তে পারে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ হিসাব কষছে, দুই চুলার বিল বাবদ তাদের খরচ কতটা বাড়বে?

আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যয় ওঠাবেন। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্যাসের বাড়তি দাম ওঠাবে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়াবেন ভাড়া। এমনকি ভোজ্যতেল-চিনির দামেও পড়তে পারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রভাব। সব মিলিয়ে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়, যা উসকে দেবে মূল্যস্ফীতিকে।

বিতরণকারী কোম্পানিগুলো গত ডিসেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি)। গতকাল বুধবারও দুটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অনুমিতই ছিল। গত বছরের এপ্রিল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, যার দাম পড়ছে প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৩০ টাকা। এ দর দেশীয় গ্যাসের চার গুণের বেশি। এলএনজির কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। গণশুনানি করে বিইআরসি গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়িয়েছিল। অবশ্য ভোটের আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় গ্যাসের বাড়তি দাম সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপায়নি। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে সেটি সমন্বয় করা হয়।

ভোটের দুই মাস পর এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিইআরসি।

বিতরণকারীরা মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো। এবারের প্রস্তাবে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ১০৩ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে পরিবহন, বিদ্যুৎ, পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতে ব্যয় বাড়বে। এই বাড়তি ব্যয়ের প্রতিটি অর্থ আবার ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে আদায় করবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মূল্য সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।

শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে রপ্তানি খাত। যেসব পণ্যের একটি বড় অংশ দেশে আমদানি হয়, তাদের বিপদটাও কম নয়। রপ্তানি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দেশে উৎপাদন খরচ বাড়লে বাজার পেয়ে যেতে পারে আমদানি পণ্য।

বিদেশি সুতার সঙ্গে তেমনই এক লড়াই দেশের বস্ত্রকল বা টেক্সটাইল মিলগুলোর। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী মনে করেন, প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়ালে একটি বস্ত্রকলও টিকে থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে গ্যাসের মূল্য বাবদ প্রায় ১৪ সেন্ট (১১ টাকা ৭৬ পয়সা) খরচ হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়লে এ ব্যয় বেড়ে ২৮ সেন্টের (২৩ টাকা ৮০ পয়সা) কাছাকাছি দাঁড়াবে। কিন্তু বর্তমানে সুতা উৎপাদনের যে খরচ, সেটাই উঠছে না। বিদেশি সুতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাচ্ছে না।

ইস্পাত খাতের উৎপাদনে গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এক টন রড উৎপাদনে প্রায় সাত হাজার টাকা ব্যয় হয় জ্বালানির পেছনে। প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে রড উৎপাদনে ব্যয় আরও সাত হাজার টাকার মতোই বাড়তে পারে। এখন প্রতি টন ভালো মানের রড বিক্রি হয় ৬৫-৬৭ হাজার টাকায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শেখ মাসাদুল আলম বলেন, আগামী দিনগুলোতে ক্রেতার ওপর বাড়তি চাপ আসতে পারে। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়বে, ডলারের দাম বাড়ছে। নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন কার্যকর হলে করের চাপও বাড়বে।

দেশে এখন দৈনিক মোট গ্যাস সরবরাহ প্রায় ৩২০ কোটি ঘনফুট, যার ৪০ শতাংশই বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত হয়। গ্যাসের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি তুলবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের দামের চাপ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রভাব শিল্পেও পড়বে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেল ও চিনির কাঙ্ক্ষিত মূল্য হিসাব করতে একটি ব্যয় বিবরণী অনুসরণ করে। সেখানে দেখা যায়, প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ ব্যয় ৫০ পয়সা। তেলের ক্ষেত্রে তা ৬০ পয়সা। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সেটার প্রভাব তেল-চিনির ওপর পড়বে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তেল, চিনি, আটা, ময়দা, সুজি, পোলট্রি খাদ্য ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন করি। সব ক্ষেত্রেই প্রচুর গ্যাস-বিদ্যুৎ লাগে। দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই এসব পণ্যের উৎপাদন খরচের ওপরও একটা প্রভাব পড়বে।’

১০ বছরে ৬ বার
দেশে গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৬ বার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্যাপটিভ ও যানবাহনের সিএনজির দাম। দুই চুলার গ্যাস বিল ছিল ৪৫০ টাকা, যা এখন ৮০০ টাকা। নতুন প্রস্তাবে তা ১ হাজার ৪৪০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। এক চুলার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত দর ১ হাজার ৩৫০ টাকা। ২০০৮ সালের এপ্রিলে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ টাকা ৭৫ পয়সা। এখন তা ৪০ টাকা, যা বাড়িয়ে ৫৪ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

নতুন প্রস্তাবে বিদ্যুতে ২০৮ শতাংশ, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯৬ শতাংশ, শিল্পে ১৩২ শতাংশ ও বাণিজ্যিক খাতে ৪১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক ফারজান নূর ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এবারের গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি গলদে ভরা। এলএনজি আমদানি করে দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মেশানোর আগে দাম পড়ে প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা। অথচ এখনই সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা, যা ৪৮ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে গোটা পরিবহন সেক্টর অস্থির হয়ে উঠবে।

স্থগিত চেয়ে আবেদন
গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ এবং ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার পুনর্নির্ধারণে গণশুনানির জন্য বিইআরসির দেওয়া নোটিশ স্থগিত চেয়ে করা আবেদনের ওপর ৩১ মার্চ আদেশের জন্য দিন রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে আদেশের এ দিন ধার্য করেন।

বিইআরসি গত অক্টোবরে গ্যাসের বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা চ্যালেঞ্জ করে ক্যাবের আহ্বায়ক ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনটি করেছিলেন। নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরুর পর তিনি হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন করেন, যার ওপর গতকাল শুনানি হয়। আদালতে আবেদনকারীপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী রিপন কুমার বড়ুয়া। পেট্রোবাংলার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর বিইআরসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিন।

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, গণশুনানির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়নি। ফলে গণশুনানি চলতে আইনগত কোনো বাধা নেই।

বাম জোটের হরতালের হুমকি
গ্যাসের দাম নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসি কার্যালয়ের সামনে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। বাম জোটের নেতারা দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার কড়া সমালোচনা করেন। এ সময় তাঁরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে হরতাল কর্মসূচির হুমকি দেন। সমাবেশে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা রুহীন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ বক্তব্য।