বিপন্ন প্রাণিকুলের আশ্রয় তানিয়া খানের চিরবিদায়

বাড়িতে প্রাণীর পরিচর্যায় ব্যস্ত তানিয়া খান। তাঁর এমন সাহচর্য আর মিলবে না।  ফাইল ছবি
বাড়িতে প্রাণীর পরিচর্যায় ব্যস্ত তানিয়া খান। তাঁর এমন সাহচর্য আর মিলবে না। ফাইল ছবি

তাঁকে সবাই চিনতেন বন্য প্রাণীর কাছের মানুষ বলেই। সারা বেলা তাঁর কাটত বন্য প্রাণীর সেবা-শুশ্রূষা করে। সারাক্ষণ ওদের নিয়েই তাঁর যত চিন্তা, যত কাজ। কোথাও কোনো বিড়ালছানা বা কুকুরছানা রাস্তার পাশে পড়ে আছে। তাদের উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন। মায়ের মমতা দিয়ে সেবা করতেন। ওরা সুস্থ হলে যার যার জায়গায় ছেড়ে দিতেন তিনি।

এই তিনি তানিয়া খান (৪৭)। বন্য প্রাণী গবেষক, সংরক্ষক। অন্যধারার প্রাণিপ্রেমী মানুষটি গতকাল বুধবার না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর বন্য প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল সবাইকে মর্মাহত করেছে। মৃত্যুর সময়টিতেও মেছো বাঘের একটি ছানা ছিল তানিয়ার পরিচর্যায়। ৪ মার্চ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মমরুজপুর এলাকায় মনু নদের পাড়ে শিশুদের হাতে ওই মেছো বাঘের বাচ্চাটি ধরা পড়েছিল। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ বাচ্চাটি উদ্ধার করে তাঁর কাছে হস্তান্তর করে। যেদিন ওই বাচ্চাটি তানিয়ার কাছে দেওয়া হয়, সেদিনই তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন। সেসব ভুলে মেছো বাঘের ছানাটি পেয়ে লেগে যান তাকে বাঁচিয়ে তোলার কাজে।

পাখি ও বন্য প্রাণীদের সেবা দিতে তানিয়া খান প্রতিষ্ঠা করেন সোল (সেভ আওয়ার আনপ্রোটেক্টেড লাইফ)। নিজেই সোলের পরিচালক। নিজের খাবারদাবারের খোঁজ নেই। পশুপাখিদের খাবার জোগাড় করেছেন সবার আগে। ব্যস্ত থেকেছেন তাদের নিয়ে।

বন্য প্রাণীর ছবি তুলতেন আগে থেকেই। এরপর বিয়ে হয় বন বিভাগের রেঞ্জার মুনীর আহমেদ খানের সঙ্গে। কখনো মুনীর আহমেদ খানের সঙ্গে, কখনো একা, কখনো অন্যদের সঙ্গে দল বেঁধে ছুটে গেছেন এ–বন থেকে ও–বনে। বার্ড ক্লাবের সদস্য হয়ে প্রাণিকুল রক্ষায় সময়-শ্রম দিয়েছেন। কাজ করেছেন আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর ন্যাচার), নিসর্গসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে।

বছর চারেক আগে তানিয়ার স্বামী মুনীর মারা যান। কিন্তু তানিয়া আর ফিরে যাননি সুনামগঞ্জে নিজেদের বাড়িতে। বন-প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা মৌলভীবাজারেই থেকে যান। কালেঙ্গা এলাকায় বাসা তৈরি করেন। সেটি সোলের কার্যালয়ও। বাসার সব কটি কক্ষ, পাশের একটি পুরোনো মাটির ঘর ও উঠোন—সবখানেই ছিল প্রাণীদের ছড়াছড়ি। সবখানে প্রাণীদের উপস্থিতি। অল্প কিছুদিনেই এলাকার ছোট–বড় সবার সঙ্গে তাঁর তৈরি হয়ে যায় গভীর সংযোগ। প্রতিবেশীরাও তাঁর প্রাণিপ্রেমে মুগ্ধ হয়েছেন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেশীর অনেকেই তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। পশুপাখির খাওয়াদাওয়া দেখতেন। সেবাযত্ন দেখতেন।

বাসায় তানিয়া খান একা থাকতেন। অন্যদিন সকাল ৯টা-১০টায় দরজা-জানালা খোলেন। কিন্তু গতকাল ছিল তার ব্যতিক্রম। সময়মতো দরজা-জানালা খোলা না দেখে প্রতিবেশীরা ডাকাডাকি করেন। সাড়া না পেয়ে বেলা ১১টার দিকে দরজা ভেঙে বিছানায় তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর চলে যাওয়া বিপন্ন প্রাণিকুলের জন্য আরও এক বিপন্নতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এখানে-ওখানে কুড়িয়ে পাওয়া বন্য প্রাণীর ছানা হয়তো এরপরও উদ্ধার করা হবে। কিন্তু কে আর অমন মাতৃ–মমতা দিয়ে সেগুলোকে আগলে রাখবে? মানবশিশুর মতো কোলে ধরে দুধ পান করাবে? ভালোবাসার ওমে জড়িয়ে রাখবে?