চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নির্দেশে অভিজিৎকে হত্যা

মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় চাকরিচ্যুত সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। জিয়ার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ১২ জন জড়িত থাকলেও পাঁচ জঙ্গির পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এক জঙ্গি বন্ধুক যুদ্ধে মারা গেছেন। অভিযুক্ত সব আসামি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (পুরোনো নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। গতকাল বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম এই অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করা হয়েছে ২৫ মার্চ।

অভিযোগপত্রভুক্ত অপর পাঁচ আসামি হলেন আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব (৩৪), মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার (২৫), আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম (২৪), শফিউর রহমান ফারাবী (২৯) ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ৩০)। তাদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক আছেন।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে দুর্বৃত্তরা অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে গুরুতর আহত করে। তাঁরা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়্যার প্রকৌশলী ছিলেন, রাফিদা চিকিৎসক। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলার তদন্তভার ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগে (সিটি) ন্যস্ত করা হয়।

হত্যা পরিকল্পনা ও খুন
অভিজিৎ রায়কে কীভাবে হত্যা করা হয়, কারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়, এর বিস্তারিত বর্ণনা মামলার আসামি আবু সিদ্দিক সোহেল আদালতে দিয়েছেন। ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সোহেল বলেন, ২০১৪ সালে তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হন। পরে মেজর জিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি জিয়া ও আবিরের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৫ সালে সায়মন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে তাঁকে আসতে বলেন। সায়মন, আকরাম ও হাসান এলিফ্যান্ট রোডে থাকতেন। বাসায় যাওয়ার পর সায়মন তাঁকে জানান, অভিজিৎ রায়কে হত্যা করতে হবে। আকরাম ওই বাসায় থাকা ল্যাপটপে অভিজিতের ছবি দেখান। ফেসবুকের লিংক দেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী ইন্দিরা রোডের যে বাসায় উঠেছিলেন, আকরাম তার আশপাশ ঘুরে আসার পর মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। জিয়ার নির্দেশ ছিল, অভিজিৎকে বইমেলায় ফেলে হত্যা করতে হবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সোহেল, আকরাম, মোজাম্মেল ও হাসান বইমেলায় যান। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই চার জঙ্গি বইমেলা থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে অবস্থান নেন। তখন সায়মন আনসারুল্লার অপারেশন শাখার নেতা মুকুল রানাকে খবর দেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিজিৎ তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে টিএসসির উত্তর-পূর্ব পাশে যান। তখন আনসারুল্লার অপারেশন শাখার চারজন অভিজিৎকে কুপিয়ে জখম করেন। বাধা দেওয়ায় স্ত্রীকে আঘাত করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জঙ্গি নেতা মেজর জিয়া, সেলিম, আকরাম, হাসান ও মোজাম্মেল। মূলত তাঁরা সেখানে প্রহরী হিসেবে অবস্থান করেন, যাতে অভিজিৎকে হত্যা করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারেন সবাই। অভিজিৎকে খুন করার জন্য চাপাতি কেনার টাকা দেন মুকুল। টঙ্গী থেকে চারটি ব্যাগ ও চারটি চাপাতি কেনেন জঙ্গিরা।

কারা খুনে অংশ নেয় সে ব্যাপারে অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেদিন আলী ওরফে খলিল ও আনিক অভিজিৎকে প্রথমে কোপায়। তখন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন আরাফাত ও অন্তু। এই চারজন আনসারুল্লার অপারেশন শাখার সদস্য। অভিজিৎকে কোপানোর সময় একজন রিকশাচালক এগিয়ে আসলে আনিক চাপাতি উঁচিয়ে ভয় দেখান। পরে তাঁরা পালিয়ে যান। মেজর জিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নির্দেশনা দিয়ে অভিজিৎকে হত্যা করেন। অভিজিৎকে হত্যায় প্ররোচনা দেন শফিউর রহমান ফারাবী। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ১২ জঙ্গির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়। এর মধ্যে মুকুল বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকলেও জঙ্গি সেলিম, হাসান, আলী ওরফে খলিল, আনিক, অন্তুর পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারেনি বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ। আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান হলেন সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক।