বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৯৯ বছর

বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৯৯ বছর। বাংলার সবচেয়ে রূপবান পুরুষ হিসেবে তাঁকে বর্ণনা করেছিলেন কবি রফিক আজাদ। বেঁচে থাকলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিতে তিনি কী করতেন?

১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।’

ওই জন্মদিনে সহবন্দীরা তাঁকে ফুল দিয়েছিলেন, কারাগারে কেক নিয়ে এসেছিলেন বেগম মুজিব আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা। ছোট্ট রাসেল তাঁর বাবাকে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকায় আর চট্টগ্রামে শেখ মুজিবের জন্মদিন উদ্‌যাপিতও হয়েছিল।

সে ছিল ঘোরতর দুঃসময়। একের পর এক মামলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কারণ তিনি ঘোষণা করেছিলেন বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা। পরে তো তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যান্টনমেন্টে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলার মানুষ তাঁকে মুক্ত করে আনবে, আর তাঁকে উপাধি দেবে বঙ্গবন্ধু খেতাব।

আজ বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস। তিনি আমাদের দিয়েছেন স্বাধীনতা, দিয়েছেন একটা জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত আর একটা মানচিত্র। দিয়েছেন রাষ্ট্র, দিয়েছেন পরিচয়। আজ বাংলাদেশ যে বহু ক্ষেত্রে ভালো করছে, এগিয়ে যাচ্ছে, তার মূলে আছে আমাদের স্বাধীনতা; আর সেই স্বাধীনতার সামনে আছেন বঙ্গবন্ধু।

আমাদের দেশ যত দিন থাকবে, নদ-নদী যত দিন বইবে, তত দিনই কীর্তি থেকে যাবে বঙ্গবন্ধুর। কারণ তিনি হাজার বছরের বাঙালিকে প্রথম এনে দিয়েছিলেন রাষ্ট্র।

আগামী ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বছরটিকে পালন করা হবে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে। এর মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও থাকবে।

জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি ১০২ সদস্যবিশিষ্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন জাতীয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সভাপতি। আরেকটি ৬১ সদস্যের জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এর সভাপতি। দুই কমিটির প্রথম সভা ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় এসেই মিশে গেলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন–সংগ্রামে। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে হরতাল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। তারপর থেকে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির প্রশ্নে। কতবার জেলে গেছেন! গোয়েন্দারা মুচলেকার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করত তাঁকে। তিনি বলতেন, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন, তবু বাংলার মানুষের মুক্তির প্রশ্নে আপস করবেন না।

বারবার নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আপস করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর ফাঁসি হতে পারত। তাঁকে গুলি করে মারার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। একাত্তর সালে পাকিস্তানের কারাগারে তাঁর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। মৃত্যুকে তিনি ভয় পাননি। বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।’

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত স্বদেশে ফিরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

তাঁর জীবনের একটাই ছিল সাধ, একটাই ছিল স্বপ্ন, একটাই ছিল লক্ষ্য—স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন সঞ্চারিত করেছিলেন। তিনি আমাদের ‘স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’।

তিনি বলেছিলেন, তাঁর বড় গুণ হলো দেশের মানুষকে তিনি বেশি ভালোবাসেন। তাঁর দুর্বলতাও ছিল, দেশের মানুষকে তিনি একটুও বেশি ভালোবাসেন। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ শেষ করে তিনি বলেছিলেন, ‘মনে আছে, আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব!’

তিনি রক্ত দিয়ে মানুষের ভালোবাসার রক্তঋণ শোধ করেছিলেন।

তিনি নেই, তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ আছে। আর আছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ, তাঁর লেখা বইগুলো।

তাঁর জন্মের শতবর্ষ আমরা সত্যিকার অর্থে উদ্‌যাপন করতে পারব, যদি তাঁর সেই কথাগুলো আজ আমরা কাজে লাগাতে পারি।