বাদী জানেন না পাল্টে গেছে এজাহার

>

• ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
• আসামিকে বাঁচানোর জন্যই তাঁকে না জানিয়ে এজাহার বদলে দিয়েছে পুলিশ

মায়ের অভিযোগে বলা হয়েছিল, ২০ বছর বয়সী তরুণ সুমন তাঁর ৭ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন। তিনি নিজে দেখেছেন সে ঘটনা। অথচ মামলার এজাহারে সুমনের বয়স লেখা হয়েছে ১৮। বলা হয়েছে, ধর্ষণ নয়, শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করতে দেখেছেন তাঁর মা।

১৩ মার্চ রাতে ধর্ষণের অভিযোগ করা হলেও মামলা হয়েছে ১৫ মার্চ। শিশুটির মায়ের করা অভিযোগে শিশুটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির কথা উল্লেখ ছিল। তবে মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, মেয়েটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের সঙ্গে এজাহারের মিল নেই কেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শুভ আহমেদ বাদীকে জানিয়েছেন, বাচ্চা মেয়ে, ধর্ষণের শিকার হলে সে মারা যেত। মেয়েটা বেঁচে আছে বলেই ধর্ষণচেষ্টা লেখা হয়েছে।

মামলার বাদীর অভিযোগ, আসামিকে বাঁচানোর জন্যই তাঁকে না জানিয়ে এজাহার বদলে দিয়েছে পুলিশ। এমন অবস্থায় শিশুধর্ষণের সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে শিশুটির পরিবার। প্রথম আলোকে শিশুটির মা বলেন, অসুস্থ মেয়েটা চার দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অথচ পুলিশ বলছে প্রাথমিক চিকিৎসার কথা।

ফতুল্লা থানার এসআই শুভ আহমেদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়ের মায়ের কথায় ধর্ষণ লেখা যায় না। মেয়ে বলছে, ওর কিছু হয় নাই। তাই ধর্ষণচেষ্টা লেখা হইছে।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, শুক্রবার সকালে তারা (পুলিশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে শিশুটির বড় ভাই জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে আসামির অবস্থান সম্পর্কে জানানো হলেও আসামিকে গ্রেপ্তার করেননি। পরবর্তী সময়ে তারা (শিশুটির পরিবার) নিজেরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানা-পুলিশের সহায়তায় আসামিকে আটক করে ফতুল্লা থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তিনি আরও জানান, ঘটনার পর থেকেই আসামিপক্ষ এলাকার প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।

বাদীকে না জানিয়ে এজাহার পরিবর্তনের বিষয়ে এসআই শুভ আহমেদ বলেন, ‘আমি এজাহার পাল্টাইনি। বাদী নিজেই এটা সংশোধন করেছেন। সেখানে তাঁর স্বাক্ষর আছে।’ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কথামতো সাদা কাগজসহ বেশ কিছু কাগজে স্বাক্ষর করার কথা স্বীকার করে মামলার বাদী বলেন, ‘পড়াশোনা না জানায় কখন কোথায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, সেটা জানি না।’

সুষ্ঠু বিচার না পাওয়া নিয়ে শিশুটির পরিবারের শঙ্কা একদমই উড়িয়ে দেওয়া যায় না উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি রাকিব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাদীকে না জানিয়ে এজাহার পরিবর্তন করা আইনবিরোধী। এর মাধ্যমে আসামিকে বাঁচানোর চেষ্টার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১৩ মার্চ ফতুল্লার তল্লা এলাকায় ৭ বছরের শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় শিশুটিকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।

শিশুটির পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখার দাবি জানান মহিলা পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি লক্ষ্মী চক্রবর্তী। এমন ঘটনায় শঙ্কা প্রকাশ করে নারী সংহতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক পপি রানী সরকার বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগে আমরা শঙ্কিত। এমন ঘটনা ধর্ষকদের উৎসাহিত করবে। নির্যাতিতরা আইনের প্রতি আস্থা হারাবে।’

জানতে চাইলে ফতুল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘ক’ সার্কেল) ইমরান মেহেদী বলেন, ‘দুই রকমের এজাহারের বিষয়টি আমাদের জানা নেই। অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’