ডিপো থেকে চলতে দেওয়া হচ্ছে না বিআরটিসির বাস

অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া ও নিরাপদ যাত্রীসেবার জন্য অনেকেই বিআরটিসির বাসে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে নরসিংদীর ডিপো থেকে সরকারি এই সংস্থাটির বাস চলাচল বন্ধ আছে প্রায় এক দশক ধরে। ২০১০ সালে স্থানীয় বেসরকারি বাসমালিকদের আন্দোলনের মুখে ডিপো থেকে বিআরটিসির বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে নরসিংদী পৌরসভা-সংলগ্ন বিআরটিসি বাসের ডিপোর বিপরীত পাশে ছিল বেসরকারি মালিকদের বাসস্ট্যান্ড। নরসিংদী শহরের ওপর চাপ কমাতে পৌরসভার তৎকালীন মেয়র লোকমান হোসেনের উদ্যোগে ২০১০ সালে বাসস্ট্যান্ডটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। এই বাসস্ট্যান্ডের প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাছাকাছি শালিধা এলাকায় ‘নরসিংদী আন্তজেলা পৌর বাস টার্মিনাল’ স্থাপন করা হয়। এতে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। পৌর শহর থেকে অটোরিকশায় ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে সেখানে গিয়ে বাসে উঠতে যাত্রীদের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়। সে সময় রাজধানীর গুলিস্তানগামী মেঘালয় সার্ভিস ও মহাখালীগামী পিপিএল পরিবহন টার্মিনাল থেকে চলাচল শুরু করে। বেসরকারি বাসগুলো টার্মিনাল থেকে চলাচল করলেও বিআরটিসির বাসগুলো নিজস্ব ডিপো থেকেই চলাচল করত। তবে কিছুদিন না যেতেই বেসরকারি পরিবহন

সংস্থাগুলোর আন্দোলনের মুখে বিআরটিসির বাসগুলোকেও টার্মিনাল থেকে চলতে বাধ্য করা হয়। দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্বে ঢাকা-নরসিংদী রুটে বিআরটিসির বাস চলাচল কমতে কমতে পাঁচ বছর আগে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

১৪ মার্চ বিআরটিসির নরসিংদী ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার ৫০ গজ দূরত্বে পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রায় ১৬০ শতাংশ জায়গার ওপর বিআরটিসির এই ডিপো। এর ভেতরে চারটি দোতলা বাসসহ মোট ২৭টি বাস বিকল হয়ে পড়ে আছে। এর কোনোটির চাকা নেই, কোনোটি ভাঙাচোরা। তবে অধিকাংশই লক্কড়ঝক্কড়। ডিপোর দুটি বাস ভালো থাকলেও ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে পড়ে আছে। এই দুটি বাস ইজারা নিয়ে শহরের ভেলানগর থেকে চালাতেন সাগর নামের একজন। তিনি জানান, এগুলোও বিকল হওয়ার পথে। ডিপোর ভেতরে দুটি ভবন আছে। লোকবলসহ সবকিছু পর্যাপ্ত থাকলেও এখান থেকে কোনো বাস চলে না। ডিপোর ব্যবস্থাপক মো. আজিজুল হক জানান, ডিপোর ৯টি বাস চলছে ভৈরব রুটে। এই ডিপোর তত্ত্বাবধানেই চলছে ভৈরবের বাসগুলো।
ডিপোর কয়েকজন কর্মী জানান, নরসিংদী-ঢাকা রুটে বিআরটিসির বাস চলাচল ২০১৪ সালের পর থেকে একেবারেই বন্ধ। বর্তমানে এই ডিপোর জন্য বিআরটিসির বরাদ্দ আছে ৩৯টি বাস। এর মধ্যে অযত্নে পড়ে থাকায় বিকল হয়ে গেছে ২৭টি। ৯টি বাস চলছে ভৈরব থেকে ঢাকা-ভৈরব রুটে। আরও তিনটি বাস বিকল হওয়ার পথে। বর্তমানে এই ডিপোর আওতায় দায়িত্বে কর্মরত আছেন ৪৭ জন।
বিআরটিসির নরসিংদী ডিপোর সাবেক এক কর্মী জানান, ১৯৯৬ সালের দিকে এই ডিপোর জন্য বিআরটিসির নতুন বাস দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর বাস পাওয়া যায়নি। বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তরের পর স্থানীয় মালিকদের বাস চলাচল বন্ধ রেখে আন্দোলন এবং তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সখ্য তৈরি হলে ধীরে ধীরে বিআরটিসির বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপোর ব্যবস্থাপক মো. আজিজুল হক এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলা নিষেধ। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মুঠোফোন নম্বর চাইলেও তিনি দেননি।
নরসিংদী যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মঈনুল ইসলাম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাত্রীদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সরকারি এই সেবা থেকে নরসিংদীর মানুষ বঞ্চিত। আসলে নরসিংদীর পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীরা চান না বলেই বিআরটিসির বাসগুলো এই রুটে চলছে না। অথচ অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া ও নিরাপদ যাত্রীসেবা পেতে বিআরটিসির বাসগুলো আবার চালু করা দরকার। আমরা বেসরকারি পরিবহনগুলোর কাছে একরকম জিম্মি হয়ে আছি।’
জানতে চাইলে নরসিংদী আন্তজেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এ এইচ এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমরাও চাই বিআরটিসি ভালো বাস এনে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করুক। কিন্তু প্রতিযোগিতায় তারা আমাদের সঙ্গে পারে না।’ বেসরকারি বাসের মালিক ও শ্রমিক সমিতির কোনো চাপ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির বাস চলাচল বন্ধের পেছনে আমাদের কোনো দায় নেই। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতারা সরকারি এই বাসগুলো ইজারা নিয়ে চালান। সরকারি খাতে লভ্যাংশের টাকা জমা না দিয়ে তাঁরা নানা রকম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।’
জানতে চাইলে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বলেন, ‘যদিও নরসিংদী রেলস্টেশনে তিনটি আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়ায় বাসের যাত্রী দিন দিন কমছে। তবু নরসিংদী-ঢাকা রুটে সাধারণ যাত্রীদের স্বার্থে বিআরটিসির বাস চলাচলের দরকার আছে। আমার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। অভিযোগ পেলে জনস্বার্থে যা করা দরকার তা–ই করব।’