বনের টুঁটি চেপে শিল্পায়ন

গাজীপুরের শ্রীপুরের বনাঞ্চলে গাছ নিধনের চিত্র। সাম্প্রতিক ছবি।  প্রথম আলো
গাজীপুরের শ্রীপুরের বনাঞ্চলে গাছ নিধনের চিত্র। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো
>

• ব্যাপক হারে কমছে সবুজ বন
• বড় হচ্ছে শিল্পাঞ্চল
• জীববৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে

রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুরের সবুজ বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ উপজেলা হিসেবেই পরিচিত শ্রীপুর। কিন্তু বর্তমানে অনেকটাই শ্রী হারিয়ে ফেলেছে শ্রীপুর। নির্বিচারে বন উজাড়, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও প্রভাবশালীদের দখলের কবলে উপজেলাটি হারাতে বসেছে তার ‘সবুজ–শ্যামল’ তকমা।

এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পুরো গাজীপুরে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ বন কমেছে। পরবর্তী চার বছরে বন কমে যাওয়ার হার অন্তত ৫-৬ শতাংশ। সে হিসাবে পরিবেশগতভাবে গাজীপুরে শিল্পায়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীপুর।

স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্রীপুরের বুক চিরে চলে যাওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কটি গত ১০ বছরে এই উপজেলাকে দিয়েছে উন্নয়নের চাবি ‘শিল্প শহর’ তকমা। এই উপজেলা এখন রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ অঞ্চলের একটি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান্তরালে উপজেলাটি তার সবুজ গাছপালা হারিয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ছয় বছর আগেও সড়কটি ছিল সবুজবেষ্টিত। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে শ্রীপুরের জৈনা বাজার পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ ছিল শাল-গজারির গাঢ় সবুজে ঘেরা। শিল্প শহরের সঙ্গে দেশের সার্বিক যোগাযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে বাধ্য হয় সরকার। সড়কটির দুই পাশের অসংখ্য গাছ কাটতে হয়েছে। তা ছাড়া, শিল্পায়ন ও দখলে পড়ে গাছগাছালির পাশাপাশি হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্যের একটি বড় অংশ। এর বাইরে মহাসড়ক থেকে দুই পাশের অন্তত আট কিলোমিটারের মধ্যেও শিল্পায়নের ব্যাপকতা নেহাত কম নয়। সেসব জায়গায় শিল্পাঞ্চল তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক বন উজাড় করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশের বন বিভাগ বন পরিস্থিতি নিয়ে ২০০০ সালে একটি যৌথ সমীক্ষা করে। তখন গাজীপুর অংশে ট্রি কাভারেজ (বনভূমির জায়গায় বন উপস্থিতি) পাওয়া যায় ৩২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে তারা আরও একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে ট্রি কাভারেজ পাওয়া যায় ২৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। হাসান ইউসুফের মতে, শিল্পায়নের প্রভাবে বর্তমানে ট্রি কাভারেজের পরিমাণ ২০১৪ সালের তুলনায় ৫-৬ শতাংশ কমে যাওয়ার কথা। বনায়ন করে তা ১০ বছর পর কেটে ফেলার যে পদ্ধতি, তাতে বন রক্ষা হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। পৃথিবীর অনেক দেশে এই পদ্ধতি নেই। তাঁর মতে, বনের জায়গায় দীর্ঘজীবী উদ্ভিদ লাগিয়ে এগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে বড় হতে দিতে হবে। এতে বন রক্ষা হবে।

উপজেলার বারতোপা এ কে এম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, ২০ বছর আগেও শ্রীপুরের বিভিন্ন জঙ্গলে বনমোরগের দেখা মিলত। বনে দেখা যেত মথুরা, খরগোশ, শজারু, বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণী। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত ছিল বনাঞ্চল। এখন বনের প্রাণী বনে নেই। এখন বনের সেই জৌলুশ নেই।

পিয়ার আলী কলেজের অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বলেন, ‘২০০১ সালে পুরো শ্রীপুর সবুজে ঢাকা ছিল। আমি সবুজ পরিবেশ ভালোবাসি বলেই ১৯৯২ সাল থেকে শ্রীপুরে স্থায়ীভাবে থেকে গেছি। আমি দেখেছি, এই অঞ্চলের বনজুড়ে অন্তত ১৭ প্রজাতির পাখির বসবাস ছিল। সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভয়াবহতম সবুজ বিপর্যয় দেখে বিস্মিত হয়ে গেছি। যত্রতত্র কারখানা। এগুলো স্থাপনের জন্য সবুজ নিধন করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অথচ শিল্পায়নের একটা নীতিমালা আছে।’

ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. ইউসুফ বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত বেদখলে থাকা বনের জমি উদ্ধার করতে তৎপরতা চালাচ্ছি। কিছুদিন পরপর বেদখলে থাকা জমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসককে জানাচ্ছি। শিগগরিই অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে বনের জায়গা উদ্ধার করে তাতে বন সৃজন করা হবে।’