এত প্রকল্প, তবু সড়কে নৈরাজ্য

নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার কারণে রাজধানীতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে।
নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার কারণে রাজধানীতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে।

ঢাকার সড়ক ও পরিবহন খাতে এক দশকে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এরপরও রাজধানী শহরে যানবাহন চলছে হাতের ইশারায়, সংকেতবাতি প্রায় অকার্যকর। নাজুক গণপরিবহনব্যবস্থায় নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্ত নেই। ঢাকা মানেই যানজট, সড়কে মৃত্যু, দূষণ আর বেহাল সড়কের শহর।

এই পরিস্থিতির জন্য পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সরকারের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও নীতিকে দায়ী করছেন। সরকার ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) তৈরি করেছিল, যা ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা অনুসারে অনেক কাজই হয়নি। এরপর ২০১৫ সালে সংশোধিত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) তৈরি করা হয়, যার মেয়াদ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। ঢাকায় যত প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ও হবে, এর সবই এই পরিকল্পনার আওতায় হওয়ার কথা। আরএসটিপিতে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল যানবাহন পরিচালনা নিশ্চিত করা এবং বাসসেবার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাদ দিয়ে সরকার বিপুল ব্যয়ে উড়ালসড়কের মতো বড় প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়েছে।

কিন্তু নগরবাসীর দুর্ভোগ তো কমেইনি, বরং কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক সূচকে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা প্রথম দিকেই থাকছে। গত বছর লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। এই জরিপে অপরাধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো সূচকগুলোর পাশাপাশি সড়ক ও গণপরিবহনের অবস্থা কেমন, তাও ছিল।

সড়ক পরিবহন, স্থানীয় সরকার ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় সড়ক ও পরিবহন খাতে আট বছরে সরকার খরচ করেছে ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। বর্তমানে সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উত্তরা থেকে মতিঝিল মেট্রোরেল নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণ, জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন নির্মাণ, পূর্বাচলে সড়ক ও ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন। এগুলো সব ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের যে অগ্রগতি, তাতে নির্ধারিত সময়ে এসব প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় আছে। এ ছাড়া আরও প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার প্রকল্প আসছে। এর মধ্যে আছে মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, রিংরোড, পাতালরেল নির্মাণ।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের চাহিদা বিবেচনা করেই উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। বাস্তবতার কারণে কোনোটি আগে, কোনোটি পরে বাস্তবায়িত হয়। তাঁর দাবি, মেট্রোরেল ও বাসের বিশেষ লেন প্রকল্প চালু হওয়ার পর এমনিতেই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা চলে আসবে।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসেনি
রাজধানীর সড়কে মৃত্যুর অন্যতম কারণ একাধিক কোম্পানির বাসের বেপরোয়া চলাচল। এ বিষয়টি সরকারিভাবে আরএসটিপি প্রণয়নের সময় জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার গবেষণাতেও উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে সর্বশেষ ওই গবেষণা বলছে, ঢাকায় দিনে ২ কোটি ৯০ লাখ যাতায়াত (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোনো যানে উঠে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে গেলে একটা ট্রিপ হিসেবে গণ্য করা হয়। মোট ট্রিপের সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ হয় বাস-মিনিবাসে।

আরএসটিপিতে বাসের বিশৃঙ্খলার পেছনে মালিকানার ধরন, পরিচালনা ও সড়কব্যবস্থায় ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়। এর জন্য বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এই ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার বাস ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয়টি পথে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রং থাকবে আলাদা। বিদ্যমান পরিবহনমালিকেরা এই কোম্পানিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। বিনিয়োগের হার অনুসারে মালিকেরা লভ্যাংশ পাবেন। এটা করা হলে পথে বাসের চালকদের মধ্যে পাল্লাপাল্লি করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু ২০১৭ সালে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

ঢাকার পরিকল্পনা ও প্রকল্পের সমন্বয়ের দায়িত্ব ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। জানতে চাইলে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার রাকিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাসের শৃঙ্খলার বিষয়টি নিয়ে সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে কাজ চলছে। আর সংকেত মেনে যান চলাচলের বিষয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছেন তাঁরা। স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পে জোর না দিয়ে বড় প্রকল্পে জোর দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আসলে অর্থায়নের ওপর নির্ভর করে। বিদেশিরা যেসব প্রকল্পে টাকা দিতে চায়, সেটাই আগে হয়।

পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লেন মেনে গাড়ি চলতে বাধ্য করা, ১৫ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাস তুলে দেওয়া, স্কুলবাস চালু করা, পথচারীদের ফুটপাত, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ করা, গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, যানবাহন চালানো অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধ করা এবং একেক দিন একেক এলাকার বিপণিবিতান বন্ধ রাখা। কিন্তু বিপণিবিতান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটাই এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে। বাকিগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।



উড়ালসড়কই হয়েছে বেশি
২০১০ সালের পর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, এর মধ্যে উড়ালসড়কই বেশি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসড়ক, মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক, বনানী ওভারপাস, মিরপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত জিল্লুর রহমান উড়ালসড়ক, বিজয় সরণি উড়ালসড়ক ও কুড়িল উড়ালসড়ক রয়েছে। এসব উড়ালসড়কের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। ব্যয় হয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। হাতিরঝিল প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। শেখের জায়গা-ডেমরা ও গাবতলী-শিরনিরটেক সড়ক, যাত্রাবাড়ী কাঁচপুর সেতু আট লেন করার কাজে আরও প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

এসব প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ব্যয়ও বেড়েছে। সাতরাস্তা-মগবাজার-মালিবাগ উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। দুই বছরের প্রকল্প শেষ হতে লেগেছে প্রায় ছয় বছর। মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক প্রকল্প নেওয়া থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত ১৫ বছর কেটে যায়। দুটি উড়ালসড়ক নির্মাণের সময় বিদ্যমান সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে এবং বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এই বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সারোয়ার জাহানের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটা কথা চালু হয়ে গেছে যে ঢাকায় রাস্তা কম আছে, রাস্তা বাড়াও। আর উড়ালসড়ক দেখানোর জন্য ভালো। এই দিকেই সরকার বেশি হাঁটছে। কিন্তু একটা বিষয় কেউ ভাবছে না যে বর্তমান রাস্তা ও যানবাহনের ব্যবস্থাপনা কি ঠিক আছে? উড়ালসড়কের ওপর দিয়ে কজন মানুষ চলছে, তা বিবেচনা করছে না। এ অবস্থায় বড় বড় প্রকল্প নিয়ে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ছোট যানবাহন কমিয়ে বড় যান বাড়াতে হবে। হাঁটার জন্য ফুটপাত চওড়া করতে হবে। বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনা জরুরি। এর জন্য বিশেষ লেন ব্যবস্থায় (বিআরটি) জোর দেওয়া দরকার। এতে টাকা খুব বেশি খরচ হবে না।

হাতের ইশারায় আর কত দিন?
ঢাকার যানজট নিরসনে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালের কাজে গত ১৬ বছরে কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০০০ সালের দিকে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ৭০টি জায়গায় আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০০৮ সালের দিকে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার না হওয়ায় অল্প দিনেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) ’ নামে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সরঞ্জাম কেনা হয়। এর আওতায় শহরের ৯২টি মোড়ে সোলার প্যানেল, সময় গণনাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়। এই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল-ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর।

এরপর ঢাকা সিটি করপোরেশন ও পুলিশ ‘আধা স্বয়ংক্রিয়’ ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে মোড়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের হাতে থাকবে রিমোট কন্ট্রোল। যে সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি থাকবে, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা সেখানে সবুজ বাতি জ্বালাবেন। অন্য সড়কে তখন লাল বাতি জ্বলবে। মূলত হাতের ইশারার উন্নত সংস্করণ এই আধা স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল-ব্যবস্থা। জাইকার সহায়তায় নেওয়া এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ডিটিসিএ।

ডিটিসিএ সূত্র বলছে, সংকেত-ব্যবস্থার সব যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায়। আর এটি পরিচালনা করে পুলিশ। ফলে দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ জন্যই সংকেত-ব্যবস্থা কার্যকর করা যায় না।

জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় প্রায় ৩০টি সংস্থা জড়িত। যে যার মতো করে প্রকল্প নিচ্ছে, কোনোটা সরকারের ইচ্ছায়, কোনোটা অর্থায়নকারীর ইচ্ছায় হচ্ছে। সব কটিকে যে সমন্বয় করার জন্য শক্তিশালী সংস্থা দরকার, তা নেই। ডিটিসিএ নামমাত্র এই দায়িত্বে রয়েছে। তবে তাদের সে সক্ষমতা নেই। ফলে কোন প্রকল্প আগে আর কোনটা পরে, কোনটা দরকারি আর কোনটা দরকারি নয়, তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ বড় বরাদ্দ ছাড়াই এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। উল্টো সরকার বড় প্রকল্পের পেছনে ছোটার কারণে ঢাকা শহরের এই অচলাবস্থা।