নদীর চরে ছোট ছোট 'সুন্দরবন'

>

• সামাজিক বন গড়ে তোলা হয়েছে নদীতে জেগে ওঠা চরে
• সামাজিক বনের এই প্রকল্পটির নাম ‘চর বনায়ন প্রকল্প’
• নদীর পাড়ে ৫ হেক্টর জায়গায় বনটি গড়ে তোলা হয়েছে
• বিকেলে বনের পাশে ভিড় জমে সৌন্দর্যপিপাসুদের

খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার ‘শিববাড়ী ওয়াপদা’ সড়ক ধরে এগোলে শিবসা নদীর পাড়ে চোখে পড়ে ঘন গাছপালার সবুজ বন। বনে রয়েছে গোলপাতা, কেওড়া, উড়া, কাঁকড়া, গেওয়াগাছ। গাছের ডালে ডালে মাটির ছোট কলস (ভাঁড়) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাখির বাসা। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে বন থেকে। যাঁরা সুন্দরবন সম্পর্কে জানেন, তাঁদের কাছে প্রথম দেখাতেই মনে হতে পারে এটা হয়তো সুন্দরবনের একটি অংশ।

সামাজিক এই বন গড়ে তোলা হয়েছে নদীতে জেগে ওঠা চরে। প্রকল্পের নাম ‘চর বনায়ন প্রকল্প’। মূলত নদীভাঙন রোধ, উপকূলীয় এলাকায় সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে এলাকা রক্ষা, সরকারি জমি অবৈধ দখলদারমুক্ত রাখা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পশুপাখির আবাসস্থল গড়ে তোলা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং স্থানীয়ভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানো ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য ওই বনায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান বন কর্মকর্তারা। বিকেল হলেই বনের পাশে ভিড় জমতে থাকে সৌন্দর্যপিপাসুদের।

খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার শিবসা নদীর পাড়ে বনটি গড়ে তোলা হয়েছে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার শিবসা নদীর পাড়ে বনটি গড়ে তোলা হয়েছে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

কর্মসূচির আওতায় পাইকগাছা পৌরসভার শিবসা নদীর পাড়ে প্রায় ৫ হেক্টর জায়গায় বনটি গড়ে তোলা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে পাইকগাছা ম্যানগ্রোভ বন। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয়দের নিয়ে গঠন করা হয়েছে একটি সমিতি। পাইকগাছা পৌরসভার ওই বনটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে বাতিখালী চর বনায়ন সমিতি। সমিতির সভাপতি জি এম এম আজহারুল ইসলাম বলেন, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা দখলে নিতে থাকেন প্রভাবশালীরা। তাই প্রশাসনের সহযোগিতায় নদীর ধারে গড়ে তোলা হয় ওই বন। সমিতির প্রতিটি মানুষের সঙ্গে বনটির সম্পর্ক খুবই নিবিড়।

সামাজিক বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু পাইকগাছার বিভিন্ন এলাকায় জেগে ওঠা চরে এমন বনায়ন করা হয়েছে প্রায় ৫৫ হেক্টর। এর মধ্যে সোলাদানা ইউনিয়নের ভেকটমারী ও পাটকেলপোতা গ্রামে সাড়ে ২৩ হেক্টর, লতা ইউনিয়নের দক্ষিণ হাড়িয়া গ্রামে ১২ হেক্টর, দেলুটি ইউনিয়নের সদর গ্রামে সাড়ে ১৪ হেক্টর ও পাইকগাছা পৌরসভা এলাকার সাড়ে ৫ হেক্টর জমিতে ওই বনায়ন গড়ে তোলা হয়েছে। সুন্দরবনের আদলে গড়ে তোলা ওই বনে রয়েছে কেওয়া, বাইন, গেওয়া, কাঁকড়া, সৈল ও গোলপাতাগাছ। সেখানে সুন্দরীগাছ লাগানো হলেও অধিক লবণাক্ততার কারণে তা টিকে থাকছে না।

১৭ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, বাজার থেকে থানার সামনে দিয়ে চলে গেছে একটি পিচঢালা পথ। পথের এক পাশে জনবসতি ও অন্য পাশে মৃতপ্রায় শিবসা নদী। সড়কটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাঁধের পাশ দিয়ে লম্বাভাবে চলে গেছে সবুজ বন। বিভিন্ন জায়গায় বনের মধ্যে গরু-ছাগল না চরানো ও পাখি শিকার না করার নির্দেশনা দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। কিন্তু গোলপাতাগাছের বেশির ভাগেরই পাতা নেই, গরু-ছাগলে খেয়ে গেছে। বনের মধ্যে গরু-ছাগল চরাতে নিষেধ করা হলেও দেখা গেছে অনেক গরু-ছাগল সেখানে চরে বেড়াচ্ছে। কিছু দূর গিয়েই দেখা মেলে বনের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাছের ঘের। ওই ঘেরটি করেছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা।

জানা গেছে, ২০১০ সালে পাইকগাছা উপজেলা সামাজিক বন বিভাগ লস্কর ইউনিয়নের কড়ুলিয়া গ্রামে আড়াই হেক্টর জমিতে শিবসার শাখানদীর চরে গোলপাতা লাগায়। কিন্তু সেটা টেকেনি। এরপর সোলাদানা ইউনিয়নের বেতবুনিয়া গ্রামের চরে সাড়ে ২৩ হেক্টর জমিতে করা হয় বনায়ন। ওই বনের গাছগুলো এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। আদল পেয়েছে সুন্দরবনের। কড়ুলিয়া গ্রামের ওই আড়াই হেক্টর জমিতে খানজাহান আলী মুক্ত স্কাউট গ্রুপ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে কেওড়া বন।

বনটির নাম দেওয়া হয়েছে পাইকগাছা ম্যানগ্রোভ বন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
বনটির নাম দেওয়া হয়েছে পাইকগাছা ম্যানগ্রোভ বন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন



উপজেলা বন কর্মকর্তা প্রেমানন্দ রায় বলেন, উপকূলীয় ওই এলাকাটি কয়েকটি নদী দিয়ে বেষ্টিত। কিন্তু নদীগুলো ধীরে ধীরে চর পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর চর পড়া সরকারি জমি দখল করে নিচ্ছিল স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাঁরা সেখানে ঘের করে মাছের চাষ করার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে জমিগুলো দখলমুক্ত রাখতে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ওই বনায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যদিও স্থানীয় প্রভাবশালীরা ওই বনের গাছ কেটে জমিগুলো এখনো নিজেদের দখলে রাখার পাঁয়তারা করছেন।

বেতবুনিয়া বন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোসাহিদ গাজী বলেন, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু বলতে গেলেই মারতে আসেন। এ ব্যাপারটি বন বিভাগের কর্মকর্তাসহ উপজেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো হলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বনের গাছ কেটে নেওয়ার অভিযোগ করেন পাইকগাছা পৌর এলাকার চর বনায়নের সাধারণ সম্পাদক জামিনুর ইসলামও। তিনি বলেন, চর বনায়নে প্রভাবশালীদের রয়েছে ক্ষোভ। এ কারণে তাঁরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দেন। কারণে-অকারণে বনের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন।

সামাজিক বন বিভাগ বাগেরহাট সূত্রে জানা গেছে, চর বনায়ন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বনায়ন করা হয়েছে খুলনায়। পরিমাণ ১৭৪ দশমিক ৫ হেক্টর। পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন নদীর চর এলাকায় ওই বনায়ন করা হয়েছে। বাগেরহাটে করা হয়েছে ৮৭ হেক্টর জমিতে। আর পিরোজপুরে থাকা চরে বনায়নের পরিমাণ ৪৫ হেক্টর। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই বনায়ন করা হয়।

সামাজিক বন বিভাগ বাগেরহাট অঞ্চলের বিভাগীয় কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরীগাছ না থাকলেও ওই বনগুলো সুন্দরবনের মতোই। কিছু কিছু এলাকায় বনের প্রকৃতি এমনই হয়েছে যে কেউ বলে না দিলে বোঝাই যাবে না এটা সুন্দরবনের অংশ নয়।