এসো হে প্রভু নিরঞ্জন

ফরিদপুরের মনির উদ্দীন শাহ জানালেন, তাঁর বয়স ৯০ পেরিয়ে গেছে। পাশে বসা রাজবাড়ীর আলাল ফকির ও মানিকগঞ্জের মোয়াজ্জেমের বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। তিনজনেরই সাদা বাবরি চুল ও দাড়ি। পরনেও সাদা পোশাক। তাঁরা পৃথক তিন জেলার মানুষ হলেও এক হয়েছেন ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়িতে। আসন পেতে খুঁজে ফিরছেন সাঁইজির প্রেম-ভালোবাসা। গানে গানে সাঁইজিকে আত্মার ভেতর ধারণ করার চেষ্টা করছেন।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে এখানে শুরু হয়েছে তিন দিনের উৎসব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এর নাম দেওয়া হয়েছে লালন স্মরণোৎসব।

সন্ধ্যায় কালী নদীর পাড়ে মূল মঞ্চে স্মরণোৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ। প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-উর-রশিদ আসকারী। আরও আলোচনা করেন সাংসদ আ ক ম সারওয়ার জাহান ও সেলিম আলতাফ। উদ্বোধনী ভাষণে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলে, লালন শুধু সাধু ছিলেন না, তিনি একজন সমাজসংস্কারক ছিলেন। পৃথিবীতে এখন একটা সংকটপূর্ণ অধ্যায় চলছে। লালন শাহের মতো মানুষকে অনুসরণ করলে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে হলে লালনের দর্শন বুকে ধারণ করতে হবে।

 মনির শাহ ৫০ বছর ধরে সাঁইজির ধামে আসছেন। তাঁর মতো ছেঁউড়িয়ায় লালনের হাজারো ভক্ত-অনুসারী জড়ো হয়েছেন। গানে গানে ভাব বিনিময়ে এই দোলপূর্ণিমায় সাঁইজিকে স্মরণ করছেন তাঁরা।

লালন স্মরণোৎসবের প্রথম দিনে ভক্ত–অনুসারীরা গানে গানে স্মরণ করছেন সাঁইজিকে। গতকাল কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায়।  ছবি: প্রথম আলো
লালন স্মরণোৎসবের প্রথম দিনে ভক্ত–অনুসারীরা গানে গানে স্মরণ করছেন সাঁইজিকে। গতকাল কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায়। ছবি: প্রথম আলো

ভক্ত-অনুসারীরা বলছেন, দোলপূর্ণিমা তিথিতে লালন সাঁই এই আখড়াবাড়িতে তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছ থেকে খিলাফত নিয়েছিলেন। তাই দিনটিকে আনন্দময় করে তুলতে প্রতি দোলপূর্ণিমা তিথিতে গানের আসর বসাতেন সাঁইজি। সেই থেকে শুরু। দিন যত যাচ্ছে, ভক্ত-অনুসারীদের ভিড় তত বাড়ছে।

আখড়াবাড়ির চত্বরজুড়ে সারা দেশ থেকে আসা বাউল, সাধু, ফকির ছোট ছোট আসর বসিয়েছেন। তাঁদের গান শুনতে ভিড় করছেন সাধারণ দর্শনার্থীরা। সাধুসঙ্গ, বাউলগান আর তত্ত্ব আলোচনায় সময় পার করছেন বাউল অনুসারী সাধুরা।

প্রবীণ বাউলেরা জানান, একসময় এই আখড়াবাড়িতে কোনো ভবন ছিল না, গাছগাছালিতে ভরা। মানুষের ভিড় ছিল কম। দোলপূর্ণিমায় বেশি আনন্দ হতো। এখন ভিড় বেশি। সবাই সাঁইজিকে চিনছেন, জানছেন। তাঁর বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছেন—এটা তাঁদের ভালো লাগে।

স্মরণোৎসবের প্রথম দিনে বিকেলে পরিপাটি হয়ে বসে যান সাধু গুরুরা। গুরুদের ঘিরে তাঁদের ভক্ত ও শিষ্যরা। কিছু আচার পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অধিবাস। এক সুর, এক তাল, এক মনে মিশে সবাই প্রভুকে স্মরণ করলেন। এ সময় আগমনী প্রার্থনা গান গেয়ে উঠলেন একজন ‘কোথায় হে দয়াল কান্ডারি, কোথায় রইলে হে দয়াল কান্ডারি’।

চার বছর ধরে যশোরের মেয়ে কেয়া দাস তাঁর গুরু নিজাম শাহের সঙ্গে এখানে আসছেন। নিজাম শাহের একতারার টুংটাং সুরে মন্দিরা বাজিয়ে কেয়া দাস গেয়ে উঠলেন ‘এ ভব তরঙ্গ দেখে, আতঙ্কেতে যায় জীবন, এসো হে প্রভু নিরঞ্জন’।

বাউলেরা বলেন, দোলপূর্ণিমার রাতে ফকির লালন তাঁর শিষ্যদের কাছে নতুন নতুন অনেক গান পরিবেশন করতেন। শিষ্যদের বলতেন, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’

আলোচনা শেষে প্রবীণ বাউলেরা মঞ্চে একসঙ্গে লালনসংগীত পরিবেশন করেন। পরে লালন একাডেমি ও অন্য বাউলশিল্পীরা মধ্যরাত পর্যন্ত গান পরিবেশন করেন।