তদন্ত করেই দায় সারছে পুলিশ

চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত থেকে সাধারণ নিবন্ধন শাখার দূরত্ব মাত্র এক শ গজ। হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু আড়াই বছরে একবারও সেখানে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় হয়নি নিবন্ধন শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তার। চট্টগ্রামের একটি মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষী তিনি।

এ ছাড়া সাড়ে আট বছর ধরে আরেকটি মামলায় হাজির হচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তা ও জব্দ তালিকার সাক্ষীরা।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তাঁরা সবাই পুলিশ সদস্য। সাক্ষীকে আদালতে হাজির করানোর দায়িত্ব যেখানে পুলিশের, সেখানে পুলিশ সদস্য হয়েও তাঁরা সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। এতে থেমে আছে চট্টগ্রামে মাদক মামলার বিচার।

সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, কেবল মামলা তদন্তে পুলিশের দায় শেষ হয়ে যায় না। তাঁরা বলছেন, হাজির না হওয়া পুলিশের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০০ জন।

অবশ্য এসব মামলার সাক্ষী পুলিশ সদস্যদের কারও কারও দাবি, কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরোনো ঠিকানায় সমন যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সাক্ষ্য দিতে যেতে পারছেন না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা এক জায়গা থেকে বদলি হয়ে আরেক জায়গায় যান। ডিআইজি বা এসপি অফিসে সমনগুলো পাঠিয়ে তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সময় কাগজে–কলমে ইস্যু হলেও বাস্তবে পাওয়া যায় না। এটিও খতিয়ে দেখতে হবে।

 শহীদুল হক মনে করেন, সমন পাওয়ার পরও যদি কোনো পুলিশ সদস্য যথাযথ কারণ ছাড়া সাক্ষ্য দিতে হাজির না হন, অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮তে বলা হয়েছে, বিচারের জন্য অভিযোগ আমলে নেওয়ার তারিখ থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তা না হলে আরও ৩০ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে। এর মধ্যে না হলে আরও ১৫ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে।

ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট আগামী ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগপত্র আমলে নেওয়া মাদক মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। আদেশে সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে বলা হয়। তিন বছর ধরে কারাগারে থাকা মাদকের এক আসামির জামিন শুনানি করতে গিয়ে এই আদেশ দেওয়া হয়।

আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম আদালতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা ১৬ হাজার ৪৯২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধে৵ ৫ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৪০। সাজা হওয়ার আগেই জামিনে বেরিয়ে পলাতক হয়েছেন এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি।

মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিচারাধীন বেশির ভাগ মাদক মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও জব্দ তালিকার সাক্ষী পুলিশ। এদের সাক্ষ্য ছাড়া আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। ফলে রায়ের আদেশে আসামি অব্যাহতি পেতে পারেন।

সমন ও পরোয়ানা পাওয়ার পরপরই পুলিশসহ পাবলিক সাক্ষীদের হাজির করা হচ্ছে বলে দাবি করেন নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, না আসা পুলিশসহ সাক্ষীদের তালিকা কৌঁসুলিরা দেননি।

১০০ গজ হেঁটে হাজির হচ্ছেন না তিনি

সিএমএম আদালত চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। এটি থেকে নিবন্ধন শাখার দূরত্ব মাত্র এক শ গজ। সেখানে কর্মরত এসআই জাহিদ হাসান ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় মো. শাহজাহানের কাছ থেকে ৩০টি ইয়াবা উদ্ধার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আগামী ধার্য দিনে সাক্ষ্য দেবেন বলে জানান তিনি। সাক্ষ্য হয়নি বাদী পুলিশের এসআই মজনু মিয়ারও। দুই বছর ধরে এই মামলায় একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি। পলাতক আসামিও।

১ জনেরও হয়নি সাক্ষ্য

গত চার বছরে একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি এ রকম মামলাও পাওয়া গেছে। এ রকম কয়েকটি মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ধার্য দিনে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আগামী ৯ জুন পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন সিএমএম আদালত।

২০১৩ সালের ২০ মার্চ নগরের বাকলিয়া থানার জাইল্যার চর এলাকায় মো. বাবুলের কাছ থেকে ২০টি ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় তৎকালীন এসআই আখতারুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় মোট সাক্ষী রয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে ১০ পুলিশ সাক্ষী হলেন বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা, ওই থানার তৎকালীন ওসি এ কে এম ইসমাঈল, এসআই শিবেন বিশ্বাস, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নেয়ামত উল্লাহ, এএসআই জ্যাকসন বড়ুয়া, কনস্টেবল মো. ইব্রাহীম, জুয়েল রানা, উত্তম কুমার ও কামাল পাশা। এর মধ্যে কয়েকজন জব্দ তালিকারও সাক্ষী। বাদী এসআই আখতারুল ইসলাম বর্তমানে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমন পেয়েছেন কি না স্মরণ নেই। তবে ১৪ মাস অসুস্থ থাকায় অনেক মামলায় সাক্ষ্য দিতে যেতে পারেননি।

২০১৪ সালে নগরের আকবরশাহ থানার ইস্পাহানি গেট থেকে ১০৩ গ্রাম গাঁজা উদ্ধারের মামলার বাদী আকবরশাহ থানার এসআই সেলিম মিয়া, তদন্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, পরিদর্শক আবদুল মজিদ, এএসআই মাকসুদ হোসেন ও কনস্টেবল আল আমিন সাক্ষ্য দেননি। বাদী সেলিম মিয়া বর্তমানে নগর পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত। তিনি বলেন, ‘সমন পাইনি। পেলে যেতাম।’

হয়নি দ্রুত নিষ্পত্তি

জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা কম থাকায় বিভিন্ন আদালত থেকে মাদকসহ সংশ্লিষ্ট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে আসে। ২০০৫ সালের ৩০ মার্চ জেলার পটিয়া থেকে ২০০ লিটার চোলাই মদসহ আমিনুর রশিদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবু জাফর, এএসআই হাফিজুর রহমান, পটিয়া থানার সাবেক ওসি জহিরুল হক সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সর্বশেষ গত ৩১ জানুয়ারি ও ১৩ মার্চ দিন ধার্য থাকলেও কেউ হাজির হননি। এভাবে পার হয়েছে ১০৫টি ধার্য দিন। সর্বশেষ ২০১০ সালের ৫ মে সাক্ষ্য হয়।

সমাধান কোথায়

মাদক মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় বাদী, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সাক্ষীরা ওই সময় যে ঠিকানায় থাকেন (থানায় কর্মরত) তা উল্লেখ করা হয়। পরে সমন ঘুরতে ঘুরতে কাউকে পাওয়া যায়, কাউকে পাওয়া যায় না। এ জন্য অভিযোগপত্রে সাক্ষী পুলিশ সদস্যদের মুঠোফোন নম্বর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কৌঁসুলিরা জানান, মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁদের ধার্য দিনে হাজির করা যেতে পারে।