'মেয়েটির ভাগ্য ভালো, কেউ ওকে হেনস্তা করবে না'

গণশৌচাগারে মর্জিনা বেগম। ছবি: ওয়াটারএইডের সৌজন্যে
গণশৌচাগারে মর্জিনা বেগম। ছবি: ওয়াটারএইডের সৌজন্যে

‘আমার নাম মর্জিনা বেগম। বয়স ৩০। থাকি পান্থকুঞ্জ পার্কের ফুটপাতে। আগে এখানে একটি চায়ের দোকান ছিল। ইচ্ছে ছিল একটি রেস্তোরাঁ করার। তবে আর্থিক সংগতি হয়নি বলে তা করতে পারিনি। সামান্য পুঁজি সম্বল করে এই ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানটি করেছি। এখানে সকাল আর দুপুরের খাবার বিক্রি হয়। ফুটপাতে থাকা মানুষ আর পথচারীরা আমার এখানে খেতে আসে।’ 

মর্জিনা বেগম জানান, খাবারের দোকানের জিনিসপত্র কিনতে প্রতিদিন তাঁকে বাজারে যেতে হয়। প্রতিদিন খাবার বেচে লাভ হয় হাজার টাকার মতো। তিন মেয়ে, এক ছেলে ও দিনমজুর স্বামী নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলে ও ছোট মেয়ে খাবার বানানোর কাজে তাঁকে সাহায্য করে।

মর্জিনা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে কাছের এক পাড়ায় গিয়ে শৌচাগার ব্যবহার করতাম। অন্তত ২০ জন মানুষ এটি ব্যবহার করত। অনেক অনুরোধে তারা আমাকে এটি ব্যবহার করতে দিত। সেখানে লম্বা সারিতে দাঁড়াতে হতো। পাশাপাশি শৌচাগারের ভেতরের অবস্থাও ছিল করুণ। ভেতরে সব সময় ভিজে একাকার থাকত। আসলে প্রস্রাবে ভরে থাকত। পায়খানা করে কেউ পানি দিত না। একটি বড় পাত্রে পানি থাকত। তবে হাত ধোয়ার কোনো সাবান থাকত না।’

মর্জিনা বেগম বলেন, ‘একদিন দেখলাম এই শৌচাগারের দরজায় একটি ফুটো আছে। এর মধ্য দিয়ে যে কেউ ভেতরে দেখতে পাবে। এটা দেখে আমার উঠতি বয়সী মেয়েদের কথা মনে পড়ে বেশ ভয় লাগল। তখনই এক পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি আমাকে দ্রুত বের হয়ে যেতে বলছেন। এরপর থেকে ওই শৌচাগারে যেতেই ভয় লাগত।’

মর্জিনা বেগম জানান, তাঁকে দোকান বন্ধ করে ওই শৌচাগারে যেতে হতো। এর ফলে তাঁর দোকানের অনেক খরিদ্দার অন্যত্র চলে যেত। এতে ব্যবসারও ক্ষতি হতো। তিনি বলেন, ‘এখন আমি দ্রুতই গণশৌচাগারে যেতে পারি। আর ফিরেও আসতে পারি তাড়াতাড়ি। আবার এই গণশৌচাগার ব্যবহারকারীরাও আমার দোকানে খেতে আসে। ফলে আমার ব্যবসার জন্য ভালোই হয়েছে।’

এই নারী জানান, এই নতুন শৌচাগার হওয়ার পর থেকে এখানকার মানুষের শৌচাগার ব্যবহারের ধরনই পাল্টে গেছে। এখানে যারা থাকে এবং শৌচাগার ব্যবহার করে, তারা এটি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে বেশ সচেতন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাঁদের শিখিয়েছেন কীভাবে এটি পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। একটু দম ফেলে তিনি বলেন, ‘এখন নির্ভয়ে আমার মেয়েদের এই শৌচাগারে পাঠাই। এখানকার নারী তত্ত্বাবধায়ক আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে।’

মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আগে শৌচাগার ব্যবহার করার পর আমি হাত ধুতাম মাটি দিয়ে। জানতাম এটা অস্বাস্থ্যকর। খাবার তৈরির জন্য এটা খারাপ বলে ব্যবসাতেও প্রভাব পড়তে পারে। তবে সাবান কেনার মতো অবস্থা আমার ছিল না।’

নতুন গণশৌচাগার সম্পর্কে মর্জিনা বেগম বলেন, ‘এখন এই শৌচাগারে গেলে এক সহনীয় গন্ধ আসে। শৌচাগারটির দেখভাল হয় খুব ভালোভাবে। এখানে তিনটি পৃথক বেসিন আছে। প্রতিটিতে আছে হাত ধোয়ার সামগ্রী। টয়লেট পেপার, সাবান ও ময়লা ফেলার জায়গাও আছে। এখানে লো-কমোড ও গোসলের ব্যবস্থা আছে। এখানে চপ্পল আছে। যারা শৌচাগার ব্যবহার করবে তাদের পরে থাকা জুতা খুলে চপ্পল পরে যেতে হয়। এখানকার পরিচ্ছন্নতার স্বার্থেই এটি করতে হয়। এই শৌচাগারের দেখভালের জন্য নারী কর্মী রাখা হয়েছে। নিজেকে সাফসুতরো রাখতে এই শৌচাগার আমাকে সহায়তা করেছে অনেক। আগে যেমন রোগবালাই লেগে থাকত এখন তা নেই।’

মর্জিনা বেগম আরও বলেন, ‘আমাদের মতো যারা ভাসমান মানুষ, তাদের জন্য ভালো শৌচাগারের অভাব প্রকট। শৌচাগার আমাদের জন্য সত্যিই বড় একটি ব্যাপার। আমরা চটজলদি একটা বিছানা করতে পারি কিন্তু শৌচাগার তো বানাতে পারি না। গণশৌচাগার যদি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকত, তবে আমাদের জন্য বেশ ভালো হতো। বিশেষ করে রাতের বেলা। আমাদের পরিবারে মেয়েটির ভাগ্যই খুব ভালো। কারণ, অচেনা কেউ এসে ওকে হেনস্তা করবে, এই ভয়ে থাকতে হয় না।’