টেকেরবাড়ির স্বাস্থ্য টেকাতে সচল নারীরা

মিরপুরের কালশী এলাকার টেকেরবাড়ি বস্তিতে নির্মাণ করা আধুনিক শৌচাগার। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা
মিরপুরের কালশী এলাকার টেকেরবাড়ি বস্তিতে নির্মাণ করা আধুনিক শৌচাগার। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী নাসরিন আক্তারের সকাল ও সন্ধ্যা আসত একরাশ বিরক্তি নিয়ে। সকালে উঠেই কাজে যাওয়ার তাড়া। কিন্তু শৌচাগারে যাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে মনটা খিঁচড়ে যেত। গোসল সারতে হতো প্রায় খোলা জায়গায়। এ বস্তিতে থাকা অনেক নারীর জন্য তা ছিল বড় বিড়ম্বনা। হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিকেলে ঘরে ফিরে শৌচাগারে বা গোসলে যেতে সকালের বিরক্তিই ফিরে আসত। নোংরা শৌচাগার— দুর্গন্ধ ছড়াত আশপাশে। এখন সেই দিন নেই।

মিরপুরের কালশী এলাকার টেকেরবাড়ি বস্তিতে ঢুকে ডান দিকের একটি ঘরে থাকেন নাসরিন আকতার। তাঁর ঘর থেকে শৌচাগারের দূরত্ব ১০ গজের মতো। বস্তির এই জায়গায় তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী থাকেন ১০ জন। শৌচাগার নিয়ে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাঁদের অনেকেরই।

এখানকার আরেক বাসিন্দা পোশাককর্মী মুক্তা আক্তার বলেন, ‘এহনকার এই বাথরুম (শৌচাগার) দ্যাখলে বুজতে পারবেন না কেমন ছিল আগে। আমরা যারা ভুগছি, তারাই বুঝি কী কষ্ট!’

সাদা-নীল রঙের দুটি শৌচাগার এখানে। নারী ও পুরুষের আলাদা। কোথাও দুর্গন্ধ নেই। গোসলের জন্য আলাদা জায়গা। এখানকার ১৮টি পরিবার এই শৌচাগার ব্যবহার করে। এগুলো তৈরিতে তাদের কষ্টের টাকার ভাগ আছে। নির্মাণব্যয়ের ১৫ শতাংশ দিয়েছে পরিবারগুলো। বাকিটার অর্থ দিয়েছে পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইড। একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই এ প্রকল্প চলছে। এর বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংগঠন ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)।

কালশীর বঙ্গবন্ধু কলেজে যাওয়ার আগে রাস্তার বাঁ পাশে টেকেরবাড়ি বস্তি। মোট ৫৬০ পরিবার আছে। লোকসংখ্যা ২ হাজার ২৪০। রাস্তা থেকে খানিকটা উঁচুতে এ বস্তি। পাশেই মিরপুর সিরামিক। এখানে আছে তৈরি পোশাককর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর ইত্যাদি নানা পেশার মানুষ। বস্তির মানুষ ওয়াসার পানি পেতে শুরু করে ২০০৬ সাল থেকে। তবে পুরো বস্তির স্যানিটেশন পরিস্থিতি ছিল তথৈবচ। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ইএসডিও এখানে কাজ শুরু করে বলে জানান সংগঠনটির কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার বিদ্যুৎ চাম্বুগং। তাঁর সঙ্গে দেখতে গেলাম সদ্য নির্মাণ শেষ হওয়া একটি শৌচাগার। বস্তির একেবারে উত্তর দিকে এই শৌচাগারের পাশে বসে বাসন মাজছিলেন শাহীনুর বেগম। নতুন শৌচাগার পেয়ে উচ্ছ্বসিত তিনি। এ বস্তিতে তাঁর কয়েকটি ঘর আছে। বললেন, ‘শুরুতে অনেকেই নতুন টয়লেটের জন্য পয়সা দিতে চাইত না। এখন হওয়ার পর সব দেইখ্যা সবাই খুশি।’

টেকেরবাড়ির বস্তির শাহীনুর বেগম। তাঁর মতো নারীদের দুর্ভোগ দূর করেছে নতুন শৌচাগারগুলো। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা
টেকেরবাড়ির বস্তির শাহীনুর বেগম। তাঁর মতো নারীদের দুর্ভোগ দূর করেছে নতুন শৌচাগারগুলো। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

শাহীনুরের সঙ্গে ছিলেন শাহেরা খাতুন। তিনি বললেন, ‘বর্ষা আইলে থিকথিকা হইয়া থাকত সব। এহানে আসতে মন চাইত না। মলমূত্র পইড়্যা থাকত যেহানে-সেয়ানে।’

ঝকঝকে দুই শৌচাগারের মধ্যে নারীদেরটির ভেতরটা আলাদা। এখানে একটি ঢাকা জায়গা আছে, যেটার মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের ব্যবহার্য প্যাড বা কাপড় ফেলতে পারেন। সেগুলো জমা হবে শৌচাগারের বাইরের একটি বাক্সে। নারীদের প্রতিটি শৌচাগারে এই ব্যবস্থা আছে।

পারভীন নামের এক নারী বলেন, আগে বড় একটা সমস্যা হতো মাসিকের সময়টায়। প্যাড বা ব্যবহৃত কাপড় ফেলার কোনো জায়গা ছিল না। শৌচাগারেই পড়ে থাকত।

এখানকার প্রতিটি পরিবার ৬০ টাকা করে প্রতি মাসে দেয়। এর মধ্যে ৫০ টাকা পান এক নারী। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকটি দেখবেন। আর ১০ টাকায় কেনা হয় সাবান এবং শৌচাগার পরিষ্কারের সামগ্রী। শৌচাগার ব্যবস্থাপনার যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে নারীদেরই প্রাধান্য। আবার শৌচাগার নির্মাণে নারীর ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংগঠন ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ শহীদ-উজ-জামান বলেন, বস্তিতে যেসব নারী আছেন, তাঁদের অনেকেই কর্মজীবী। তাঁদের জীবনমানের উন্নয়নের অর্থ হলো দেশের উৎপাদন বা উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। তাই এই প্রকল্পে নারীদের উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।

বস্তির স্যানিটেশন উন্নয়নে নেওয়া ও প্রকল্পের অন্যতম দিক হলো কিশোরীদের স্বাস্থ্যবিধি শেখানো। এখানে ২৫ জন কিশোরীর একটি দল আছে। তাদের মাসিকের সময় পালনীয় স্বাস্থ্যবিধিসহ পরিচ্ছন্নতার নানা বিষয় শেখানো হয়। এ দলের একজন জান্নাতুল ফেরদৌস উত্তর কালশী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। জান্নাতুল বলছিল, ‘মাসিকের মতো বিষয়টি নিয়ে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেয়েছি। খাবারের আগে-পরে হাত ধোয়া, গৃহস্থালির আবর্জনা পরিষ্কারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারের সঙ্গেও আলোচনা করি।’

নারীদের শৌচাগারগুলোর পাশে এমন ছোট্ট ঘর করে মাসিকের ব্যবহৃত কাপড় ও প্যাড ফেলার জায়গা রাখা আছে। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা
নারীদের শৌচাগারগুলোর পাশে এমন ছোট্ট ঘর করে মাসিকের ব্যবহৃত কাপড় ও প্যাড ফেলার জায়গা রাখা আছে। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

এই কিশোরীদের বলা হচ্ছে ‘চেঞ্জ এজেন্ট’ (পরিবর্তনের প্রতিনিধি)। এদের প্রত্যেকের কাছে ‘আমরা করব জয়’ লেখা একটি নীল রঙের কাগজ দেওয়া আছে। সেখানে খাবার ঢেকে রাখা, খাবার উঁচু স্থানে রাখা, পানি ফুটিয়ে খাওয়া, হাত ধোয়ার নিয়মগুলো পালনের বিষয়গুলো উল্লেখ করা আছে। ইএসডিওর এক কর্মী সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। এক চেঞ্জ এজেন্ট মহুয়া বলছিল, ‘আমাদের এখানকার পরিবেশটাই পাল্টে গেছে। শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলা শিখছি, তা-ই না, মাসিকের মতো বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনাও এখন হয়।’

নারী ও কিশোরীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির এই প্রকল্পের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ওয়াটার এইডের বাংলাদেশীয় প্রধান খায়রুল ইসলাম বলছিলেন, পর্যাপ্ত স্যানিটেশন-সুবিধা না থাকলে এর ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি হন নারীরা। তাই নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি এখানে নজর দেওয়া হয়েছে। নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য।

এ পর্যন্ত এই বস্তিতে ১১টি শৌচাগার ও স্নানাগার নির্মাণ করা হয়েছে। মোট ১৫টি করা হবে বলে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছে থেকে জানা গেছে।